জুয়ার অ্যাপ ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ ভারতে গেছে ২০০ কোটি টাকা

তিন পাত্তি গোল্ড
তিন পাত্তি গোল্ড

টেকভিশন২৪ ডেস্ক: ২০১৭ সালে ভারতের একটি প্রতিষ্ঠান মুনফ্রগ ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ ও পরিচয় হয় জামিলুর রশিদের। এরপর ২০১৮ সালে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে দেড় লাখ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন।

মুনফ্রগ ল্যাবের অনলাইন জুয়া অ্যাপ ‘তিন পাত্তি গোল্ড’- এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় গেমটিকে আরও ছড়িয়ে দিতে দেশে বৈধতা দেওয়ার জন্য কতিপয় আইনজীবীর পরামর্শে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে ‘উল্কা গেমস প্রা. লি.’ নামে একটি গেমিং ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেন জামিলুর রশিদ। 

২০১৯ সালে মুনফ্রগের ০.০১ শতাংশ উল্কা গেমসকে প্রদানের মাধ্যমে দেশে গেমিং খাতে উন্নয়নের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা প্রদানের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ হয়। দেশে গেম ডেভেলপমেন্টের অনুমোদন থাকলেও অনলাইন জুয়া/ক্যাসিনোর অনুমোদন না থাকায় উল্কা গেমস বিভিন্ন ভুল তথ্য উপস্থাপন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে আইনি বৈধতা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে। এভাবেই ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ যাত্রা শুরু করে। 

আর তিন পাত্তি গোল্ডসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অন্তত ২০০ কোটি টাকা ভারতে পাঠিয়েছেন উল্কা গেমস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জামিলুর রশিদ।

সোমবার (৩১ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

এর আগে, রোববার (৩০ অক্টোবর) রাতে র‌্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৪ এর অভিযানে রাজধানীর মহাখালী ও উত্তরা এলাকা থেকে তিন পাত্তি গোল্ডসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাঠানোর মূলহোতা উল্কা গেমস লি.- এর সিইও জামিলুর রশিদসহ ৬ জনকে আটক করা হয়। 

আটক বাকি সদস্যরা হলেন- সায়মন হোসেন (২৯), মো. রিদোয়ান আহমেদ (২৯), মো. রাকিবুল আলম (২৯), মো. মুনতাকিম আহমেদ (৩৭), কায়েস উদ্দিন আহম্মেদ (৩২)। অভিযানে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ, সিপিইউ, সার্ভার স্টেশন, হার্ড ডিস্ক, স্ক্যানার, ডিভিডি ড্রাইভ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ডেভিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র ও নগদ টাকাসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।

তিন পাত্তি গোল্ড

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিপুল অংকের টাকা বিদেশে পাচারের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। 

‘তিন পাত্তি গোল্ড’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ মূলত একটি অ্যাপ যা মোবাইলে ডাউনলোড করে খেলা যায়। এই অ্যাপের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ মুনফ্রগ ল্যাবের কাছে রয়েছে। এই অ্যাপে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ ছাড়াও ‘রাখি’, ‘অন্দর বাহার’ ও ‘পোকার’ নামেও অনলাইন জুয়ার গেমস রয়েছে। যে কোনো কাজের পাশাপাশি এই গেম খেলতে পারায় তরুণসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে এটি জনপ্রিয়তা পায়। গেমের রেজিস্ট্রেশনের পর একজন গ্রাহককে গেমস খেলার জন্য কিছু চিপস ফ্রি দেওয়া হয়। পরে গেমস খেলার জন্য অর্থের বিনিময়ে চিপস কিনতে হয়। মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে চিপস কিনে অর্থের লেনদেন হয়। 

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতিদিন প্রায় ৫০ হজার কোটি চিপস বিক্রি হয় এবং প্রতি কোটি চিপস বিভিন্ন পর্যায়ে ৪৬-৬৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন বট প্লেয়ার/রোবট প্লেয়ারের মাধ্যমে মূল গেইমারদের কৌশলে হারিয়ে প্লেয়ারদের পরে আরও চিপস কিনতে উৎসাহিত করা হয়। বাংলাদেশে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ এর চিপস বিক্রির কাজটি ১৪টি অফিসিয়াল ডিস্ট্রিবিউটর/এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। এই সকল ডিস্ট্রিবিউটরদের সাব ডিস্ট্রিবিউটরও রয়েছে।

এছাড়া প্রাইভেট টেবিল অপশনের মাধ্যমে অন্য প্লেয়ার থেকেও চিপস কেনা করা যায়। বর্তমানে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ এ প্রায় ৯ লাখ নিয়মিত গেইমার রয়েছে এবং প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার চিপস বিক্রি হয় বলে জানা যায়।

তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভার্চ্যুয়াল চিপস অর্থের বিনিময়ে ডিস্ট্রিবিউটরদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মূলত বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে চিপস বিক্রয়ের টাকা ডিস্ট্রিবিউটরদের থেকে সংগ্রহ করা হতো। বর্তমানে উল্কা গেমসের ৪টি অ্যাকাউন্টে প্রায় ৮০ কোটির অধিক টাকা রয়েছে। এছাড়া গত দুই বছর তারা মুনফ্রগ ল্যাবকে ব্যাংকের মাধ্যমে ২৯ কোটি টাকা দিয়েছে। উল্কা গেমসের মোট ৩৬ জন কর্মকর্তা/কর্মচারী ছিল। বেতন দেওয়সহ অফিস পরিচালনায় প্রতি মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হতো। এছাড়া কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বাৎসরিক বেতনের ৩০-৯০ শতাংশ হারে বোনাস দেওয়া হতো। প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেশের বাইরে অনলাইন জুয়ার অর্থ পাঠাতো। 

কে এই জামিলুন রশিদ:

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন জামিলুর রশিদ। পরে প্রাচ্যের একটি দেশ থেকে ২০১২ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করে দেশে ফেরেন। ছোটকাল থেকেই মোবাইল গেমে আসক্ত হওয়ায় ২০১৫ সাল থেকে গেমস তৈরির কাজ শুরু করেন। হিরোজ অব ৭১ ও মুক্তি ক্যাম্প নামক ২০১৭ সালে দুইটি গেম নির্মাণের জন্য তিনি সরকারের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা অনুদান পান। পরে ২০১৭ সালে মুনফ্রগ ল্যাবের সঙ্গে পরিচয় হয়। ২০১৮ সালে তিনি গেম ডিজাইন কনসালটেন্ট ও বাংলাদেশে নিযুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে মুনফ্রগ থেকে দেড় লাখের বেশি টাকা বেতনে যুক্ত হন তিনি।

পরে ২০১৯ সালে উল্কা গেমস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সিইও হিসেবে নিযুক্ত হয়ে তিনি মুনফ্রগ থেকে মাসিক প্রায় ৪ লাখ টাকা বেতন পেতেন। এছাড়া তিনি বাৎসরিক আয়ের ৯০-১০০ শতাংশ বোনাস পেতেন বলেও জানা যায়। তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে বেশ কিছু টাকা, একটি দামি গাড়ি এবং ঢাকা ও ঢাকার বিইরে ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে। 

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আটক হওয়া রিদোয়ান আহমেদ ঢাকার একটি কলেজ থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেন। ২০১৬ সালে পোর্ট ব্রিস লিঃ নামের একটি গেমিং প্রতিষ্ঠানের অ্যাডমিন অফিসার হিসেবে কাজ করার সময় জামিলুর রশিদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ২০১৯ সালে ৪০ হাজার টাকা বেতনে তিনি উল্কা গেমসে যোগ দেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় ক্রয়-বিক্রয়, ভেন্ডর ম্যানেজমেন্ট, ইভেন্ট আয়োজনসহ অফিস পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। বর্তমানে তার বেতন ১ লাখ টাকার বেশি ছিল। তার বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রচুর অর্থ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু বিনিয়োগ ও সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন সম্পদ রয়েছে বলে জানা যায়।

আটক হওয়া কায়েস উদ্দিন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং বিষয়ে বিবিএ করেন। বিভিন্ন প্রাইভেট ও এমএনসিতে চাকরি করতেন। ২০২১ সালে তিনি উল্কা গেমস লিমিটেডের হেড অব সেলস হিসেবে যোগ দেন। তার নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় ডিষ্ট্রিবিউটররা ভার্চ্যুয়াল চিপস বিক্রয়, টার্গেট অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তিনি মাসিক ২ লাখেরও বেশি টাকা বেতন পেতেন বলে জানা যায়।

সায়মন হোসেন ঢাকার একটি কলেজ থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালে উল্কা গেমসে ৪০ হাজার টাকা বেতন চাকরি শুরু করেন। তিনি উল্কা গেমস এ প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন। বর্তমানে তার বেতন ছিল প্রায় ১ লাখ টাকা। এছাড়া তিনি মুনফ্রগ লি.- এর সাথে প্রাতিষ্ঠানিক লেনদেনের দায়িত্ব পালন করতেন। 

রাকিবুল আলম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেন। তিনি ২০১৯ সাল থেকে উল্কা গেমসে  ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ এ চিপস বিক্রয়ের ডিস্ট্রিবিউটরের কাজ শুরু করেন। তিনি মাঠ পর্যায়ে ‘কে অ্যান্ড কে এন্টারপ্রাইজ’ এর নামে গ্রাহকের কাছ থেকে ভার্চ্যুয়াল চিপস বিক্রি করতেন। তিনি প্রতি মাসে প্রায় ২-৩ কোটি টাকার ভার্চ্যুয়াল চিপস বিক্রয় করতেন বলে জানা যায়। বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তার প্রচুর অর্থ রয়েছে। 

অপর আসামি মুনতাকিম আহমেদ বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে প্রাচ্যের একটি দেশ থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেন। দেশে ফিরে তিনি বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পরে ২০১৬ সাল থেকে ট্যাক্স ও ভ্যাটের কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১৯ সালে উল্কা গেমস লি.- এর পরামর্শক হিসেবে যুক্ত হন এবং বিভিন্ন কৌশলে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে ভার্চ্যুয়াল চিপস বিক্রয়ের অর্থ দেশের বাইরে পাঠানোর কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। উল্কা গেমস থেকে তাকে মাসিক দেড় লাখের বেশি টাকা দেওয়া হতো বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। 

গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান র‌্যাবের কর্মকর্তা।

তথ্য ও ছবি বাংলানিউজ অবলম্বনে।

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন