ফটোগ্রাফার হতে চাইলে পুঁজির চাইতে ইচ্ছাশক্তিই বড়’ —মঈন উদ্দিন আহমেদ, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও ফটোগ্রাফার

মঈন উদ্দিন আহমেদ

টেকভিশন২৪ ডটকমের নিয়মিত আয়োজন ‘টেক ইন্টারভিউ’। যেখানে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসা, সফলতা-ব্যর্থতা এবং অনুপ্রেরণামূলক গল্প নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।

এবারের অতিথি মেট্রোনেট বাংলাদেশ লিমিটেডের চিফ টেকনিক্যাল অফিসার (সিটিও) মঈন উদ্দিন আহমেদ। প্রযুক্তি–পেশার বাইরেও তিনি একজন সৃজনশীল মানুষ। ফটোগ্রাফি এবং লেখালেখি করছেন নিয়মিত। তাঁর প্রকাশিত বই তিনটি। ফটোগ্রাফির জন্য পেয়েছেন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অসংখ্য পুরস্কার।

তথ্যপ্রযুক্তি–পেশার বাইরে এসে মঈন উদ্দিন আহমেদের ফটোগ্রাফি–চর্চা শুরুর গল্প এবং অর্জন ইত্যাদি নিয়ে তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন টেকভিশন২৪-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মো. গোলাম দাস্তগীর তৌহিদ।

পূর্বাচলে এই ছবিটা ২০১৯ সালে তুলেছিলাম। ছবিটা স্পেনের একটা জাতীয় পত্রিকায় বড় ভাবে কাভারেজ আসছে করোনা কালীন বিশ্ব বিপর্যস্ত সময়ে।

তৌহিদ : শুরুতেই প্রযুক্তি–পেশার বাইরে এসে আপনার সৃজনশীল চর্চাগুলো সম্পর্কে জানতে চাই। ফটোগ্রাফির শুরুটা কীভাবে?
মঈন উদ্দিন আহমেদ : আমার মূল পেশা আইটি। গত ২২ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত। আমি ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। ফলে জীবনের আনন্দ-বেদনার নানা অভিব্যক্তি–অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। চারপাশের বিভিন্ন মুহূর্ত বা ঘটনা আমার আবেগকে উদ্দীপ্ত করে। মানবতা এবং দৈনন্দিন জীবনের এই বিভিন্ন অর্থপূর্ণ মুহূর্তগুলো ছবির মাধ্যমে ধরে রাখতে পছন্দ করি। বলতে পারেন মূলত শখের বসেই ফটোগ্রাফি শুরু করা। পাশাপাশি লেখালেখিও করছি।

তৌহিদ : এবার মেট্রোনেট সম্পর্কে সংক্ষেপে যদি কিছু বলতেন? 

মঈন উদ্দিন আহমেদ : মেট্রোনেট বাংলাদেশ লিমিটেড দেশে আইএসপি জগতে প্রথম পুরো ঢাকা শহরে ২০০৪ ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক তৈরি করে। প্রথম থেকেই এর সঙ্গে আমার যাত্রা শুরু। বর্তমানে প্রায় ৬০০-এর বেশি পপ নিয়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক দেশব্যাপী বিস্তৃত। মূলত কর্পোরেট গ্রাহক বিশেষ করে ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনলাইন কার্যক্রম এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এ ছাড়াও আইপি ফোন, এসএমএস, ডেটা সেন্টার, ক্লাউড সার্ভিসসহ প্রায় ৪০০ টেকনিক্যাল কর্মী রয়েছে।

তৌহিদ : ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা, অর্জন এবং চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাপারে যদি বলতেন।
মঈন উদ্দিন আহমেদ : আমি ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পুরস্কার পেয়েছি। এর মধ্যে রয়েছে Grand Winner of CBRE Urban photographer of the year 2016 (USA); Grand Winner of NPC National Exhibition 2017 (Bangladesh); 3rd Winner of Sony World Photography National Award 2017 (UK); 1st Winner of Street Category of Travel Photographer Society 2017 (Malaysia); Honorable Mention by National Geography Travel Photography Competition of 2017 (USA); 1st Winner of LensCulture Street Photography Award 2017 (USA); Honorable Mention in Street Photography Category by Mobile Photography Awards–MPA 2018 (USA); 3rd Winner, Sony World Photography National Award 2018 (UK); Honorable Mention by Siena International Photo Awards 2018 (Italy).

টঙ্গী রেলস্টেশনে তোলা এই ছবিটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতেও প্রচারিত হয়েছে এবং ছবিটা থেকে অনেক ডলারও আয় করেছি।

ফটোগ্রাফিতে প্রচুর সময় দিতে হয়—এটা আমার জন্য একটা সমস্যা। প্রফেশনাল কাজ করে এর জন্য সময় বের করা খুব কষ্টসাধ্য। ফলে দেখা যায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোকেই বেছে নিতে হয়।

তৌহিদ : ফটোগ্রাফার হতে চাইলে শুরুতে তাকে কোন্ কোন্ বিষয় জানতে ও গুরুত্ব দিতে হয়? আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
মঈন উদ্দিন আহমেদ : আপনি যে বিষয় নিয়ে ছবি তুলবেন, তার সঙ্গে এক ধরনের নিবিড় সখ্য গড়ে তুলতে হবে। বুঝিয়ে বলি, ধরেন আপনি মোমেন্ট বা স্ট্রিট ফটোগ্রাফি করবেন বা ট্রাভেল ফটোগ্রাফিতে কোথাও গিয়ে সেখানকার লাইফস্টাইলের ছবি তুলবেন। আপনাকে তখন তাদের ইমোশনকে বুঝতে হবে, তাদের একজন হয়ে যেতে হবে, তাদের মতো করে দেখার চেষ্টা করতে হবে। তবেই আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত ছবি পাবেন। আমি ছবি তোলার চাইতে ছবি তোলার সময়টাকে বেশি উপভোগ করি। নতুন নতুন জায়গা, মানুষ ও পরিবেশ আমাকে প্রভাবিত করে।

তৌহিদ : ফটোগ্রাফি বিষয়টা আমাদের ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনের কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
মঈন উদ্দিন আহমেদ : ব্যক্তিজীবনে ফটোগ্রাফি বা যেকোনো আর্ট মিডিয়ামের প্র্যাকটিসের মধ্যে দিয়ে যাওয়া উচিত। যে মিডিয়ামেই আপনি প্র্যাকটিস করেন না কেন, সেটা সফলতা এনে না দিলেও আপনাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি করে দেবে। এক্ষেত্রে ফটোগ্রাফির ইথিক্স আরও এক ধাপ এগিয়ে থাকে; কারণ এখানে মানুষের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ হয়। ছবি তোলার জন্য আপনার মধ্যে ছোট ঘটনা বা ইমোশন অনুভব করার ক্ষমতা তৈরি হয়। যেকোনো আর্ট মিডিয়াম আপনাকে প্রশান্তি যোগায়, যা আপনাকে কর্মক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত করে তোলে। ভালো ছবি তুলতে পারলে নিজের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। ফটোগ্রাফি করার সময় আপনার অভজারবেশন পাওয়ার বাড়ে, যা পেশাগত জীবনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আর যেকোনো ধরনের এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিজিট আপনার পেশাগত জীবনে ইতিবাচকভাবে সহায়তা করে।

টাঙ্গুয়ার হাওর। ২০১৬ সালে তোলা।

তৌহিদ : আপনার পেশা তো আইটি। এ ক্ষেত্রে আপনার শখের জায়গা থেকে ফটোগ্রাফি কি আপনার পেশাকে কম্পিট করে নাকি কমপ্লিমেন্ট করে?
মঈন উদ্দিন আহমেদ : এটা ভালো প্রশ্ন। একজন সিএক্সও হিসেবে শুধু নিজস্ব বিভাগেই নয়, সার্বিক ব্যবসার ওপরেই একটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে মেট্রোনেটের সিটিও হিসেবে শুধু টেকনিক্যাল সলিউশন নয়, এর খরচ ও ব্যবসায়িক রিটার্নও চিন্তা করতে হয়। ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে যে আলাদা অবজারবেশন পাওয়ার দরকার সেটা এ ক্ষেত্রে সাহায্য করে। এখন ডিজিটাল মিডিয়ামে ফটোগ্রাফি হয় এবং ডার্করুম যেখানে ছবি প্রসেস হয়—সেটা এখন আপনার কম্পিউটার, ক্যামেরা ডিজিটাল যার জন্য আমার পেশাকে কমপ্লিমেন্ট করে। আবার ছবি তোলার জন্য আপনার সাবজেক্টের সঙ্গে সখ্য করার কারণে কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ হয়। তবে কম্পিট এক জায়গাতেই করে, সেটা হচ্ছে সময়।

তৌহিদ : ডিএসএলআর ক্যামেরায় ফটোগ্রাফি এবং মোবাইল ফোনে ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে কোন্ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়?
মঈন উদ্দিন আহমেদ : ফটোগ্রাফিতে লাইট একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে সাবজেক্টের ছবি তুলবেন তার পজিশন, কোথায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলবেন বা যদি বলি কী তুলতে চান—সে অনুযায়ী লাইট ব্যবহার করতে হবে। তবে ফটোগ্রাফির মূল বিষয়গুলোর সঙ্গে কী দিয়ে ছবি তুললেন সেটার পার্থক্য নেই বললেই চলে। আপনার ছবির কন্টেন্ট যদি ভালো হয়, তাহলে এর ডিভাইস (গিয়ার) বিষয় না। কিন্তু মোবাইলের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

তৌহিদ : প্রযুক্তির কল্যাণে ফটোগ্রাফিতে কী কী পরিবর্তনে এসেছে বলে আপনি মনে করেন?  
মঈন উদ্দিন আহমেদ : ফটোগ্রাফির টেকনিক্যালে অনেক পরিবর্তন বা সুবিধা এসেছে। যেমন ডিজিটাল ক্যামেরা/মোবাইলের ক্যামেরা, মেমোরি কার্ড এসেছে ফিল্মের পরিবর্তে, ডার্করুম প্রসেসের জায়গা করে নিয়েছে সফটওয়্যার, আর্টিফিশিয়াল লাইটের অনেক পরিবর্তন আসছে প্রযুক্তির কারণে। এরিয়্যাল ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে ড্রোন একটা বিপ্লব নিয়ে এসেছে।  

সনির পুরস্কারপ্রাপ্ত এই ছবিটা ২০১৭ সালে তোলা।

তৌহিদ : ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার জন্য কেমন প্রস্তুতি বা কী পরিমাণ পুঁজির প্রয়োজন হয়?  
মঈন উদ্দিন আহমেদ : পেশা হিসেবে নিতে চাইলে বিভিন্ন প্রফেশনাল কোর্স আছে। আমাদের দেশে দুটি শিক্ষা–প্রতিষ্ঠান আছে, যারা ফটোগ্রাফিবিষয়ক বিভিন্ন কোর্স পরিচালনা করে। সেগুলো হলো—পাঠশালা ও কাউন্টার ফটো।  

আর, ফটোগ্রাফার হতে চাইলে পুঁজির চাইতে ইচ্ছাশক্তিই অনেক বড়। আপনার ভেতরের শিল্পসত্ত্বা আপনাকে যদি এদিকে যাবার উৎসাহ যোগায় তবেই যাওয়া উচিত। 

মঈন উদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে আরও জানতে : https://moinahmed.photography/

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন