“শেখ রাসেল: নির্মলতার প্রতীক, দুরন্ত প্রাণবন্ত নির্ভীক’’- আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলক

পলক
জুনাইদ আহমেদ পলক, এমপি

টেকভিশন২৪ ডেস্ক: অন্তত দুটি কারণে আমাদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যময় ১৯৬৪ সাল। প্রথমত, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে রাজনীতিতে বাঁকবদল ঘটে এ বছর। ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জ্বীবিত করা হয়।

১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির মধ্য দিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ৬-৮ মার্চ ঢাকার গ্রিন রোডের আমবাগানে আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সাধারাণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রচন্ড গতি পায়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে সম্মিলিত বিরোধী জোট (কপ) গঠিত হয়। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন নেছা রেণুর কোল আলো করে আসে এক টুকরো চাঁদের কণা। ১৩৭১ বঙ্গাব্দ, হেমন্তের প্রথম দিন। গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জি অনুযায়ী- ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের নির্মাণাধীন বাড়িতে, মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। সদ্যভূমিষ্ট শিশুর মায়ামাখা চপল চাহনির নিষ্পাপ নির্মলতায় খুশির বন্যা বয়ে যায় বাড়িতে। কে তাকে কোলে নেবে, কে আদর করবে, চোখের কাজল পরাবে কে, নরম তুলতুলে গায়ে কে মাখিয়ে দেবে পাউডার- এই নিয়ে সারাদিন ব্যতিব্যস্ত সময় কাটাতে থাকে শেখ পরিবার।

বড় বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং বড় ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামালের নয়নের মণি হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে শিশু রাসেল। রাতের ঘুম শেষে, পিতা মুজিবের প্রশস্ত বুকের ওপর ছোট্ট পাখির মতো শুয়ে শরীরের উষ্ণতা নিতো সে। বঙ্গবন্ধুর হৃদপিণ্ড জুড়ে প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসে ধমনীর স্পন্দনে- তখন স্বৈরাচার আইয়ুব বিরোধী স্লোগান প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। সামরিক স্বৈরশাসকের গ্রাস থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য, রাজনীতির উত্তাল সাগরে আশার তরণী ভাসিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় পার করছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের তরুণপ্রজন্মের নিউরণ জুড়ে তখনমুক্তির স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করেছিল, ঠিক এরকম একটি সময়ে ছোট্ট রাসেলের মুখেও আধো আধো বুলি ফুটতে শুরু করে।

একপর্যায়ে, ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। এরপর দেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে গণমানুষের কাছে গিয়ে বোঝাতে থাকেন সোনার বাংলা শ্মশান কেন? বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকসহ আপামর জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে পাকিস্তানি জান্তারা। ৮ মে রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য জেলে রাখে তারা। ঘুম থেকে উঠে আর পিতাকে খুঁজে পায় না ছোট্ট রাসেল সোনা।

সময়ের সাথে সাথে, বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা সারাদেশের ঝিমিয়ে পড়া মানুষকে জাগিয়ে তুলতে থাকে, অন্যদিকে মায়ের স্নেহের আঁচল ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা শুরু করে প্রাণচঞ্চল রাসেল। অস্থির প্রজাপতির মতো এঘর-ওঘর ছুটে বেড়াতে শুরু করে সে। বড় বোন শেখ হাসিনা ততদিনে ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি এবং ছাত্রলীগ নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। কিন্তু ছোট্ট রাসেল কী আর অতকিছু বোঝে। রাসেলের কাছে তিনি শুধুই হাঁসু আপা। তাই বড় আপার লম্বা দোদুল বেণী ধরে শিশু রাসেল মাঝে মাঝেই খেলায় মেতে ওঠে।

শিশু রাসেলের বয়স তখন দেড় বছর। পরিবারের সবার সাথে জেলবন্দি পিতাকে দেখতে সেই ছোট থেকেই কারাগারে যেতো রাসেল। অবুধ রাসেল পিতাকে জড়িয়ে ধরে বুকের ওম নিতো, জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চাইতো। ছোট আপা রেহানার চিঠি পকেটে করে নিয়ে জেলগেটে বাবাকে দিতো। বাবাকে রেখে আর আসতে চাইতো না। অবশেষে রাসেলকে বোঝানো হয়েছিল যে, জেলটাই তার বাবার বাড়ি। অবশেষে পিতাকে রেখে ফেরার সময় কখনো মা ফজিলাতুন নেছা, আবার কখনো মলিন মুখে হাঁসু আপার কোলে উঠতো।

পিতার অবর্তমানে পিতৃস্নেহ বঞ্চিত রাসেল নিজের আম্মাকেই আব্বা বলে ডাকতে শুরু করেছিল। কী নিদারুণ এক শোকাবহ শৈশব: বঙ্গবন্ধু তার কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে শিশু রাসেলের স্মৃতি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।

এরমধ্যেই ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গোপন বিচার শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর। সেনানিবাসে নিয়ে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। চাইলেও আর পরিবারের সঙ্গে তার দেখা হতো না। অস্থির রাসেল বাবাকে একনজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতো। প্রতিদিন রাতে বাবার গল্প শুনতে শুনতে মলিন মনে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়তো। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি জান্তারা মুক্তি দিতে বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধুকে। পিতার প্রত্যাবর্তনে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে ছোট্ট রাসেল। নির্ভীক চিত্তে দুরন্ত গতিতে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে ধানমণ্ডির ছায়াঘেরা সড়কে, চঞ্চল প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে থাকে বাড়ির আনাচে কানাচে।

রাসেলকে নিয়ে কারাগারের রোজনামচা’র ২৭ মে এবং ২৮ মে ১৯৬৭ সালের স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন. … আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে ৬ দফা মানতে হবে- সংগ্রাম, সংগ্রাম চলবে চলবে….. ভাঙা ভাঙা করে বলে, কী মিষ্টি শোনায়। জিজ্ঞাসা করলাম, ও শিখল কোথা থেকে। রেণু বলল, বাসায় সভা হয়েছে তখন কর্মীরা বলেছিল, তাই শিখেছে।

এরমধ্যেই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। মা ফজিলাতুন নেছা শেখ রাসেলকে ভর্তি করে দেন শিশুশ্রেণিতে। ৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে নৌকা মার্কায় একচেটিয়া ভোট দেয় জনগণ। কিন্তু পাকিস্তানিরা মেতে ওঠে নতুন ষড়যন্ত্রে। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে ওঠে সারা দেশ। বঙ্গবন্ধুর বাড়িকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষ স্লোগান দিতে থাকে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এসব দেখতে দেখতে স্লোগান শিখে ফেলে ছোট্ট রাসেল। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু নিজ বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন, তা দেখে নিজের সাইকেলে একটা ছোট পতাকা লাগিয়ে নেয় রাসেল। জনতার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান তোলে সে-           জয়য়য় বাংলা……….

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পর তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানিরা। ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেচ্ছা, তার অন্তঃসত্ত্বা কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সাড়ে ছয় বছরের শিশু শেখ রাসেলকে গৃহবন্দি করা হয়। মায়ের কোলে মাথা রেখে খালি মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে রাসেল। আকাশে যুদ্ধ বিমানের মহড়া শুরু হলে কানে তুলা গুঁজে রাখতো ছোট্ট রাসেল।

এরমধ্যে ২৭ জুলাই জন্ম নেন সজীব ওয়াজেদ জয়। এরপর থেকে রাসেল যেন একটু প্রাণ ফিরে পেলো, সে সময়ে অসময়ে নবজাত ভাগনে জয়ের সাথে সময় কাটাতো। এমনকি বিমানের শব্দ শুনলে নিজ দায়িত্বে জয়ের কানের মধ্যেও পরম যত্নে তুলা গুঁজে দিতো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।

১৯৭১ সালে, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি জান্তাদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করে আপামর বাঙালি। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় অর্জনের পর, ১৭ তারিখ মুক্ত হয় বঙ্গবন্ধুর পরিবার। ঢাকার রাজপথের জয় বাংলা স্লোগানে কণ্ঠ মিলিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিশু রাসেল।

এরপর দেশে ফিরেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্নির্মাণের কাজে মন দেন বঙ্গবন্ধু। জীবনের সাত বছর পেরিয়ে, এই প্রথম পুরো পরিবারের সাথে নিয়মিত সময় কাটানোর অবকাশ পায় রাসেল। পিতা মুজিবের সৌজন্যে বিশ্বনেতাদের সাথেও করমর্দনের সুযোগ হয় রাসেলের। শিশু রাসেলের আত্মবিশ্বাসী বাচনভঙ্গি, বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি ও নির্মল অভিব্যক্তি মুগ্ধ করে তাদের। রাসেলের প্রতিটি নির্ভীক পদচারণায় ফুটে ওঠে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির বিষাক্ত ষড়যন্ত্রের ছোবলে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে- এই সম্ভাবনাময় দুরন্ত শিশুমন নীল হয়ে যায়। রাতের শিউলি ভোরের বকুল ঝরে পড়ার আগেই, ঘাতকের বুলেটে রক্তের সাগরে ডুবে যায় সবার প্রিয় পাখিটি। রাসেলের নির্মম মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে বিশ্বমানবতা। কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রকৃতি।

তবে অনাবিল স্বপ্ন নিয়ে যে শিশুটি অকালে হারিয়ে গেল, সময়ের সাথে সাথে তার প্রাণশক্তি যেনো ছড়িয়ে পড়লো প্রতিটি শৈশবে। একেকটি রক্তিম প্রভাত যেমন জেগে ওঠে ঝাঁক ঝাঁক বিহঙ্গ-কূজনে, তেমনি প্রতিটি বাঙালি শিশুর দামাল দুরন্তপনায় বেঁচে থাকে শিশু রাসেল। এদেশের প্রত্যেক শিশুই বেড়ে উঠুক নির্মল চিত্তে, নিরাপদ পরিবেশে। বিকশিত শৈশব শেষে প্রতিটি শিশুই পরিণত হোক একেকজন দেশপ্রমিক নাগরিক হিসেবে।

(লেখক: জুনাইদ আহমেদ পলক, এমপি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী)

 

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন