সাশ্রয়ী মূল্যে স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে করণীয় বিষয়ে বিটিআরসির কর্মশালা

টেকভিশন২৪ ডেস্ক: দেশের ব্রডব্যান্ড সেবায় মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে সাশ্রয়ে স্মার্ট ডিভাইস প্রাপ্তি তথা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, কম্পিউটার এবং অন্যান্য ইন্টারনেট সক্ষম পরিষেবার বিষয়ে একটি পরামর্শমূলক কর্মশালার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।

বৃহস্পতিবার সকালে বিটিআরসির প্রধান সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মাননীয় মন্ত্রী জনাব মোস্তাফা জব্বার। বিটিআরসির চেয়ারম্যান জনাব শ্যাম সুন্দর সিকদারের সভাপতিত্বে এতে বিশেষে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব জনাব আবু হেনা মোরশেদ জামান। কর্মশালায় জানানো হয় যে, বিটিআরসি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, এসপায়ার টু ইনোভেট (a2i) এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সহযোগিতায় বাংলাদেশের জন্য সময়োপযোগী জাতীয় ব্রডব্যান্ড নীতিমালা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে বিটিআরসির লিগ্যাল এন্ড লাইসেন্সিং বিভাগের কমিশনার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন বলেন, একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা অনেক বেড়েছে। ধনী-দরিদ্র ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ডিজিটাল বৈষম্য নিরসন, রাষ্ট্রীয় সেবা দ্রুত সময়ে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের অন্যতম লক্ষ্য।

পরবর্তীতে সাশ্রয়ী মূল্যে স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে করণীয় বিষয়ে উপস্থাপনায় বিটিআরসি’র সিস্টেমস এন্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেঃ জেনাঃ মোঃ নাসিম পারভেজ বলেন, বর্তমানে দেশের প্রতিটি খাতেই ডিজিটাল রূপান্তর হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির মুল ভিত্তি হবে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গর্ভনমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমি। এছাড়া দেশে ২০১৩ সালে যেখানে স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ছিল মাত্র ৪.০৭ শতাংশ ২০২২ সালে তা ৫৩.৬৮ শতাংশে এসে দাড়িয়েছে এবং বর্তমানে ১৫ টি কারখানায় স্থানীয়ভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদিত হচ্ছে যার বাৎসরিক বাজার মূল্য ১৫ হাজার কোটি টাকা যার মাধ্যমে ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে বলে তিনি জানান।

মোবাইলফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে মোবাইল অপারেটরগুলো গ্রাহকের জন্য সুলভে ডিভাইস প্রাপ্তির উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশে তা দৃশ্যমান নয়। বিটিআরসি‌‌‌র উদ্যোগে মোবাইল অপারেটর ও মোবাইল ডিভাইস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়ে সাশ্রয়ে ডিভাইস পৌঁছে দিতে কাজ করতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব জনাব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, সুলভে স্মার্ট ডিভাইস উৎপাদনের পাশাপাশি উক্ত ডিভাইস সকল শ্রেণী পেশার মানুষ ব্যবহারের সুযোগের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় ব্রডব্যান্ড পলিসিতে স্বপ্লমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে স্মার্ট এডুকেশন সিস্টেম চালুর পাশাপাশি সর্বত্র স্মার্ট কানেক্টিভিটি থাকতে হবে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, মোবাইল হ্যান্ডসেট কেবল কথা বলার মাধ্যম নয় বরং এটা দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। মোবাইল ডেটার মেয়াদ বেধে দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও ব্রডব্যান্ডের মত ‘এক দেশ এক রেট’ চালুর উদ্যোগ নিতে বিটিআরসির প্রতি আহবান জানান। মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রিতে সরকারকে ভ্যাট দিতে হয় যা মওকুফের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রিতে কর মওকুফের বিষয়ে আলোচনা করা হবে। ২০৪১ সালকে সামনে রেখে ডিজিটাল প্রযুক্তির সম্ভাব‌্য পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস‌্যপূর্ণ ও জনগণের চাহিদা উপযোগী ব্রডব‌্যান্ড নীতিমালা প্রণয়নে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন তিনি। বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান জনাব শ্যাম সুন্দর সিকদার তাঁর বক্তব্যে বলেন, গ্রাহকদের কিস্তিতে মোবাইল ডিভাইস প্রদানে মোবাইল অপারেটরদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরো বলেন, প্রযুক্তি পণ্যের বাজার বড় করা গেলে স্বল্প কর আরোপিত হলেও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির সুযোগ থাকে। প্রান্তিক মানুষ সহজেই যাতে ডিজিটাল কানেক্টিভির সাথে অর্ন্তভূক্ত হতে পারে সেজন্য মোবাইল অপারটেরদেরকে সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদানের আহবান জানান তিনি।কর্মশালার দ্বিতীয় সেশনে অংশগ্রহণকারীরা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে ওয়ার্কিং সেশনের কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। গ্রুপগুলো নিম্নোক্ত চারটি বিষয়ে চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন: (১) আভ্যন্তরীণ ডিভাইস উৎপাদন,সংযোজন ও বিতরণে সহায়তা এবং বাজার সম্প্রসারণে অর্থায়ন ও বিনিয়োগের সুযোগ (২) স্মার্ট ডিভাইস দেশের সর্বত্র সুলভে প্রাপ্তির লক্ষ্যে অনুকূল নিয়ন্ত্রক অনুশীলনসমূহ গ্রহণ (৩) লক্ষ্যযুক্ত, সুপরিকল্পিত কর এবং রাজস্ব নীতি প্রতিষ্ঠা করা যা ডিভাইসের বাজারে বৃদ্ধি এবং ক্রয় ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে (৪) স্থানীয়ভাবে তৈরি স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে ডিজিটাল পরিষেবা প্রদানে ইকোসিস্টেম তৈরি এবং স্থানীয় কনটেন্ট ব্যবহারে গুরুত্ব দিয়ে ডিজিটাল রূপান্তর নিশ্চিত করা। গ্রুপ-১ এর সুপারিশমালায় ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ডিভাইস তথা সুইচ, রাউটার, কনভার্টার, ওয়াইফাই রাউটার, ডংগল এবং গ্রাহক কর্তৃক ব্যবহৃত ডিভাইস তথা স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ইন্টারনেট অব থিংস ডিভাইসগুলো গ্রাহক পর্যায়ে সাশ্রয়ে প্রাপ্তির জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি তুলে ধরা হয় । এছাড়া, স্মার্ট ডিভাইসের বাজার সম্প্রসারণে স্থানীয়ভাবে স্মার্ট ডিভাইস উৎপাদন, সংযোজন ও বিতরণে কর হ্রাস, ঋণ সুবিধা প্রদান, ব্যবসাবান্ধব পলিসি প্রণয়ন এবং ফোরজি নেটওয়ার্কের মান বাড়নোর কথা উল্লেখ করা হয়।

গ্রুপ-২ এর সুপারিশমালায় বিদ্যমান ব্রডব্যান্ড পলিসিতে যেসব বিষয় পরিবর্তন করা প্রয়োজন তার মধ্যে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তথা ব্যাটিারি , চার্জার, হেডফোন সংক্রান্ত বিষয়টি পলিসিতে অন্তর্ভূক্তকরণ এবং ভ্যাট হ্রাসের বিষয়টি উল্লেখ করা হয় । এছাড়া স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার বৃদ্ধিতে ফোরজি হ্যান্ডসেটের সংখ্যা বাড়ানো, সমন্বিত ডিভাইস বিতরণ চ্যানেল চালু এবং অবৈধ মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রি বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণের কথা তুলে ধরা হয়।

গ্রুপ-৩ এর সুপারিশমালায় স্মার্ট ডিভাইস উৎপাদন, সংযোজন, আমদানি ও বিতরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান কর হ্রাসের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানিতে কর হ্রাস, আমাদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর রহিত করা, কর্পোরেট কর হ্রাস এবং ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রির জন্য আলাদা পলিসি ও কর সুবিধা রাখার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। যেহেতু দেশের ৬৯ শতাংশ মানুষ এখনো ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত নয় তাই ডিজিটাল লিটারেসি বাড়ানো ও ডিভাইস সহজলভ্যতার বিষয়টিও সুপারিশমালায় তুলে আনা হয়। এছাড়া, স্মার্টফোনের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশে উৎপাদিত মোবাইল হ্যান্ডসেট রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগানোর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

গ্রুপ-৪ এর সুপারিশমালায় সাধারণ মানুষকে ডিজিটাল কনটেন্ট গ্রহণে আগ্রহীকরণে গ্রাহকের চাহিদার ভিত্তিতে বিনোদনমুলক, শিক্ষামুলক, স্বাস্থ্য, কৃষি ও খেলাধুলা বিষয়ক ভিডিও কনটেন্ট প্রস্তুত, সকল আর্থিক লেনদেনের সমন্বয় সাধন, ডিজিটাল স্বাক্ষরতার হার বাড়ানো, নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল সেবা গ্রহণে সচেতনতা তৈরি বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

দ্বিতীয়ার্ধে পলিসি সংক্রান্ত সুপারিশমালা নিয়ে প্রধান অতিথি হিসেবে আলোচনা করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (টেলিকম) মোঃ মাহবুব উল আলম। বিটিআরসি’র অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগের কমিশনার অধ্যাপক ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরীর সভাপতিত্বে সমাপনী ও ভবিষ্যত নীতিনির্ধারণী আলোচনায় অংশ নেন বিটিআরসি’র স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেঃ জেনাঃ মোঃ মনিরুজ্জামান জুয়েল, এমটবের মহাসচিব ব্রিগে: জেনা: এস এম ফরহাম (অব.), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. মইনুল জাবের, টেলিফোন শিল্প সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব সাঈদ মাহমুদ এবং আইএসপিএবি’র সভাপতি মোঃ এমদাদুল হক।

বিটিআরসি’র স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেঃ জেনাঃ মোঃ মনিরুজ্জামান জুয়েল বলেন, ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ডিভাইস তৈরির জন্য স্থানীয়ভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এছাড়া, স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধিতে থ্রিজি হ্যান্ডসেট উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, ধীরে ধীরে টুজি হ্যান্ডসেট বন্ধ করে ফোরজি মোবাইল হ্যান্ডসেটের ব্যবহার বৃদ্ধির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গ্রামীণ পর্যায়ে স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধিতে নেটওয়ার্কের মানোন্নয়ন করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, গুণগত হ্যান্ডসেট যাতে বাজারে আসে সেজন্য বিটিআরসিতে টেস্টিং ল্যাব স্থাপন করা হবে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ মাহবুব উল আলম বলেন, ২০০৯ সালে প্রণীত ব্রডব্যান্ড পলিসিতে স্বপ্লমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অনেকগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে এবং কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। নতুন ব্রডব্যান্ড পলিসিতে স্বপ্লমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বিষয়টি বিদ্যমান থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

সভাপতির বক্তব্যে বিটিআরসি’র অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগের কমিশনার অধ্যাপক ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ ইন্ড্রাস্টির সাথে অ্যাকাডেমিয়ার লিংকেজ স্থাপনের মাধ্যমে তাদের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে থাকে। বাংলাদেশে পণ্যের সঠিক বাজারজাতকরণ কৌশল বাস্তবায়ন হয়না জানিয়ে তিনি বলেন, যে কোনো পণ্যের প্রসারে বাজারজাতকরণ কৌশল অবলম্বন করতে হবে। জাতীয় ব্রডব্যান্ড পলিসি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থার বিষয়টি উল্লেখ থাকবে বলেও জানান তিনি।

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন