ক্যাশ সার্ভার প্রতিস্থাপন সহ ইন্টারনেট সেবায় বিভিন্ন অসংগতি দূর করার আহবান বিশেষজ্ঞদের

‘এক দেশ এক রেট – কোন পথে বাংলাদেশের ইন্টারনেট’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনা।

টেকভিশন২৪ ডেস্ক রিপোর্ট: গত ৬ই জুন বাংলাদেশ টেলিকমিনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন “এক দেশ এক রেট” নামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারেটের জন্য নতুন ট্যারিফ ঘোষনা করে।এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে চ্যালেঞ্জ, করণীয় এসব সার্বিক বিষয় আলোচনা করার জন্য  “এক দেশ এক রেট – কোন পথে বাংলাদেশের ইন্টারনেট” শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনার আয়োজন করে বাংলাদেশ সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেটরস ফোরাম (বিডিসাফ)।

বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক এর  সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান , আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম, সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক , ফাইবার এট হোম  সিটিও সুমন আহমেদ সাবির, এনটিটি লিমিটেড এর সিনিয়র নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার ফকরুল আলম পাপ্পু, বাংলাদেশ সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেটর ফোরাম এর আহবায়ক জুবায়ের আলমাহমুদ হোসেন, বিকাশ লিমিটেড এর  হেড অফ আইটি গভর্নেন্স নাজমুল করিম।

আলোচনাটি সমন্বয় ও সঞ্ছালনা করেন বিডিসাফের যুগ্ম-আহবায়ক মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক এর  সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান বলেন, “আই সি টি পলিসি হয়েছে, ব্রডব্যান্ড পলিসি হয়েছে। ২০১৫ সালের পর থেকে ব্রডব্যান্ড পলিসি আপডেট হচ্ছেনা। ৫০০ টাকায় ইন্টারনেট দেওয়ার জন্য কি ধরণের অবকাঠামো দরকার সেই নিকেশ করা দরকার। ক্যাশ সার্ভার ধরে অনেক প্রান্তিক জায়গায় নব্বই শতাংস ইন্টারনেট সার্ভ করা যায়। ক্যাশ সার্ভার পলিসি(নীতিমালার) মাধ্যমে নিশ্চিত করা যেতে পারে কেননা লোকাল ট্রাফিক লোকাল রাখাই শ্রেয়।। ইন্টারনেটের বিশাল জগত এখনো আমরা তুলে ধরতে পারিনি । এক দেশ এক রেট- ট্রান্সমিশনের সাথে সম্পর্কিত বিধায় ক্যাশিং সার্ভারের সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুনভাবে ভাবে দরকার।“

আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, “প্রান্তিক আই এস পি গুলো বিভিন্ন সিলিং বা ফ্লোর প্রাইসে যাওয়া উচিত। ছোট ছোট স্ল্যাভে প্রাইস আনা যেতে পারে। এতে লেভেল প্লে ফিল্ড নিশ্চিত করা যাবে।“

আইএসপিএবি সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক বলেন, “পুরো সিদ্ধান্তটি ধোঁয়াশার জন্ম দিয়েছে। আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি। এই সিদ্ধান্তে প্রান্তিক আই এস পি গুলো বানিজ্যিক হুমকির মুখে পড়বে। সারা বাংলাদেশে ২৪ টেরার উপর ট্রান্সমিশন দরকার হবে। এক মাস পর যদি ক্যাশ সার্ভার তুলে নিলে বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ ট্রাফিক লস হবে। একদিকে ব্যবহারকারীর জন্য সাশ্রয়ী অন্যদিকে প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের খরচ বেড়ে যাবে। আমি মনে করি , সরকারের সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনা করা উচিত। অন্যথায়, আই এস পি সঠিকভাবে সেবা দিতে অসফল হতেও পারে। আমাদের অন্তত ছয় মাস থেকে এক বছর সময় দেওয়া উচিত, তাতে আমরা দেখব কোথায় নিরাপত্তা ব্যাঘাত হয়।  আমরা গাইডলাইন নিয়ে একটা বিভ্রান্তের মধ্যে আছি। প্রান্তিক আইএসপি র জন্য সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন এখনো আমরা নিতে পারিনি। প্রান্তিক পর্যায়ের  ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখছেনা।বিদেশি বিনিয়োগ আনার ব্যাপারে দেশি উদ্যোক্তাদের সাথে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। দেশেই অনেকেই বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।“

ফাইবার এট হোম  সিটিও সুমন আহমেদ সাবির বলেন, “এক রেট আনার জন্য যে সময়ে আসা দরকার সেই সময়ে এখনো আমরা পৌছেছি কিনা ভাবতে হবে। ট্রান্সমিশন বিভিন্ন এলাকার সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত। দুই এক বছর পর হয়ত ট্রান্সমিশন কস্ট সহনীয় পর্যায়ে আসবে। ঢাকার আর ঢাকার বাইরে ট্রান্সমিশন কস্ট এখন তারতম্য আছে (১০ জি বিবেচনায়)। এক রেটে এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত। আই এস পির কোয়ালিটির ভিন্নতা নিশ্চিত কিভাবে করা হবে। মার্কেট কম্পিটিশন কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে ভাবা উচিত। প্রান্তিক পর্যায়ে কোয়ালিটি নিয়েও ভাবা উচিত। সার্ভিসের হাইরেরকি তে লেয়ার অনুযায়ী যে খরচের তারতম্য আছে তা বিবেচনা করা উচিত। এমনভাবে করা উচিত যাতে প্রান্তিক আইএসপি ৫০০ টাকায় যাতে ভাল সার্ভিস দিতে পারে, তখন এটি অবশ্যই বাস্তবায়ন করা যায়। জেলা পর্যায়ে ভাল কানেক্টিভিটি আছে। উপজেলা পর্যায়ে ও খারাপ না। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার গ্রাহকের সাথে ফাইবার কানেক্টিভিটি দিয়ে তার ব্যবসায়িক সামঞ্জস্যতাও বিবেচনায় আনা উচিত।“

প্রোগ্রামের রেকডিং শুনতে নিচের ইউটিউব লিংক :

https://www.youtube.com/watch?v=RHtigghIowg 

এনটিটি লিমিটেড এর সিনিয়র নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার ফকরুল আলম পাপ্পু আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, “সারা বিশ্বেই ক্যাশ সার্ভার দিয়ে ইন্টারনেট সার্ভ হচ্ছে।  প্রান্তিক ব্যবহারকারীর যত কাছে ক্যাশ বা কন্টেন্ট সার্ভার রাখা যায় তত ভাল।  ক্যাশ সার্ভার যদি সরিয়ে নেওয়া হয়, কোয়ালিটি বিঘ্নিত হবে।  ল্যাটেন্সি বেড়ে যাবে। এতে ওভার অল ইম্প্যাক্ট হবে । এতে কস্টিং ইম্প্যাক্ট ও হবে।  ক্যাশ সার্ভার তুলে নিলে ৫০% ব্যান্ড উইথ ব্যবহার বেড়ে যাবে যার ইমপ্যাক্টে দামে পড়বে অবশ্যই। প্রান্তিক আইএসপিকে এই বেশি ব্যবহারের দাম ত তুলে আনতেই হবে।  ক্যাশ সার্ভার এক ধরণের একটা প্রক্সি সার্ভার। ক্যাশ সার্ভার নিরাপত্তার জন্য হুমকি আমার কাছে মনে হয়না।   ইন্টারনেটের ইকোসিস্টেমে প্রভাব পড়বে এই সিদ্ধান্ত। ক্যাশ সার্ভার বন্ধ করলে গ্লোবাল সিডিএন অপারেটর রা ও হয়ত বিভ্রান্ত হতে পারে। ক্যাশ সার্ভারে প্রান্তিক পর্যায়ে নিরাপত্তা হুমকি হতে পারে এ ধরণের কোন ধারণা আমার নায়।  “

বিকাশ লিমিটেড এর  হেড অফ আইটি গভর্নেন্স নাজমুল করিম বলেন, “এক দেশ এক রেট – সেবার জন্য কোয়ালিটি নিশ্চিত করা উচিত। যারা সেবা দিবে, তাদের ইস্যুগুলো যদি সমাধান করা না হয়, তাহলে এই সিদ্ধান্ত সাসটেইনেবল করা উচিত। প্রান্তিক সার্ভিস প্রোভাইডারদের ইস্যুগুলো প্রাধান্য দিয়ে এনালাইসিস করা উচিত। নিরাপত্তার জন্য সিডিএন নিরাপত্তাজনিত ইস্যু থাকার কথা না। এখান থেকে কন্টেন্ট শুধু ডাউনলোড হয়। এখানে নিরাপত্তাজনিত কন্টেন্ট সরিয়ে নেওয়ার জন্য গুগল, ফেসবুক এর সাথে সরকারের সম্পর্ক শক্ত করা উচিত।  প্যানডামিক সময়ে গুগল, ফেসবুকের উপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। এসবের কন্টেন্ট যদি শুধু স্টার টপোলজি বা ঢাকা কেন্দ্রিক হয়, তা প্রত্যাশিত নয়।  বিটিআরসি কে উদ্যোগ নিতে হবে যাতে NIX নেটওয়ার্ক আরো কিভাবে বিস্তৃত করা যায়।“

আলোচনার শুরুতে বিডিসাফের আহবায়ক জুবায়ের আলমাহমুদ হোসেন বলেন, “এই সরকারের আমলে দেশের ইন্টারনেটের দাম প্রতি এমবি  ১ লক্ষ টাকা থেকে কমে ৫০০ টাকার নিচে এসেছে, আজ গ্রহক পর্যায়ের দাম নির্ধারণ প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে প্রত্যাশিত সুফল পেতে রেয়ে গিয়েছে কিছু বাধা।  অনতিবিলম্বে IIG ও NTTN প্রাইস নির্ধারণ করা । ক্যাশ সার্ভার আছে বিধায় আমরা বাফারফ্রি ভিডিও দেখতে পারছি, এটাকে নিন্ম পর্যায় থেকে সরিয়ে নিলে ইন্টারেটের গতি আবার আগের সেই কচ্ছপ গতিতে ফিরে যাবে। এক দেশ এক রেট বাস্তবায়ন চরম ভাবে বাধাগ্রস্থ হবে। ISP দের মধ্যে লেভেল পেলেংই ফিল্ড নষ্ট হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত একটা বাস্তব স্বমত ইকো সিস্টেম তৈরি না হয় ক্যাশ সমূহ আগের স্তরেই রাখাতে হবে । ওভারহেড ক্যাবলের উপরে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন।“

সঞ্চালক মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম আলোচনার প্রারম্ভিকতায় বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে বলেন, “বিটিআরসি সারা দেশের জন্য গ্রাহক পর্যায়ে ৫ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণ করেছে ৫০০ টাকা। এ ছাড়া ১০ এমবিপিএসের মূল্য ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং ২০ এমবিপিএসের মূল্য ১১১০ টাকা থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরের ব্যবহারকারীরা ব্রডব্যান্ড সংযোগের জন্য এখন এর চেয়ে বহুগুণ খরচ করেন। সেদিক বিবেচনায় নতুন নির্ধারিত মূল্য তাদের জন্য সাশ্রয়ী। এমন উদ্যোগের ফলে তাদের ইন্টারনেট সংযোগের খরচ স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এর উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু সমস্যা হলো, এটাকে কার্যকর করার জন্য আনুষঙ্গিক উপাদানগুলোর কথা বিটিআরসি  ভেবেছে কিনা। ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইএসপি) জন্য সেবা মূল্যের আওতায় ব্যান্ডউইথের দাম এবং ট্রান্সমিশন ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অন্তর্ভূক্ত। এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তৃতীয় পক্ষের হাতে ছেড়ে দিয়ে খরচ কম-বেশি সমন্বয় করতে পারলেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বাদ থেকে যায়।

প্রোগ্রামের রেকডিং শুনতে নিচের ফেসবুক লিংক –

https://fb.watch/6vX6uutplW/ 

যেখানে নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) ও ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ের (আইআইজি) জন্য ইন্টারনেটের দামের নির্ধারিত কোনো গাইডলাইন নেই, আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো কম মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দিতে কিভাবে কাজ করবে।  গুগল বা ফেসবুকের মতো টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা বাড়াতে এবং দ্রুত ও সহজে সেবা দিতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেটার জন্য ক্যাশ সার্ভার বসিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের কোনো থানা পর্যায়ের একজন গ্রাহক গুগল বা ফেসবুকে যখন কোনো কনটেন্ট খুঁজবে, তখন তা প্রথমবার এই টেক জায়ান্টদের মূল সার্ভারে গিয়ে হিট করবে। সেখান থেকে ওই ডেটা স্থানীয় ক্যাশ সার্ভারে জমা হবে। এরপর একই কনটেন্ট যদি আবার কেউ খুঁজতে যায়, তখন স্থানীয় সার্ভার থেকেই পাবে। ফলে পুনরায় পুরো নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। একদিকে ‘এক দেশ এক রেট’ কর্মসূচি, ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে ক্যাশ সার্ভার বন্ধের নির্দেশনা।

স্পিডটেস্ট-এর সূচকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতিতে ১৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৬। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ডাউনলোড গতি গড়ে ৩৩.৫৪ এমবিপিএস বলে ওই সূচকে উঠে এসেছে। বিটিআরসির হিসাবে, দেশে গত মার্চ শেষে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সংযোগ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৮ লাখ। এক বছর আগেও সংযোগ সংখ্যা ১৮ লাখ কম ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে বর্তমানে ইন্টারনেট মৌলিক চাহিদার পর্যায়ে চলে এসেছে।“

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন