অতিমারির দ্বিতীয় বছরে তথ্যপ্রযুক্তির বাজেট

আগামী অর্থবছরের বাজেটের আয়তন ছয় লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে যা বর্তমান বছরের সংশোধিত  বাজেটের চেয়ে প্রায় শতকরা বারো ভাগ বেশী। এক বছরেরও বেশী সময় ধরে চলমান করোনা অতিমারির কারনে রাজস্ব আহরন কম হলেও অর্থনীতির চাকা সচল রাখার লক্ষ্যে বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীন ঋণ বৃদ্ধির মাধ্যমে অনেক ধরনের ব্যবসায়িক প্রনোদনা ও সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। 
 
এই অতিমারির সময়ে সরকারি ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম সচল রাখার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তা হচ্ছে আমাদের জাতীয় পর্যায়ে কম-বেশী সকল ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্লাটফর্মের ব্যবহার। স্বাভাবিক ভাবেই নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী নেতা ও সাধারন নাগরিক – সকলেরই প্রত্যাশা ছিল বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাত অগ্রাধিকার পাবে। সরকার তাদেরকে নিরাশ করেনি। রাজস্ব বাজেটে আবর্তক খরচের মাত্রা মোটামুটি এক থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আগামী উন্নয়ন বাজেট এবছরের সংশোধিত আকারের তুলনায় দ্বিগুনেরও বেশী। ২০২১-২২ অর্থবছরেই প্রথমবারের মত তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন বাজেট এক হাজার কোটি ছাড়াল। 
 
ডিজিটাল বাংলাদেশ এর অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৯ এ সরকার গঠন করার পর থেকেই তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উত্তরোত্তর বর্ধমান আর্থিক সংশ্লেষ হয়ে আসছে। এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু যেই ডিজিটাল বাংলাদেশ অঙ্গীকারকে ঘিরে এই ক্রমবর্ধমান আয়োজন সেই আয়োজনে বহুলাংশেই স্থানীয় উদ্যোক্তারা অনুপস্থিত। বড় আকারের সব ডিজিটাল প্রকল্পই জামাই আদরে বিদেশী ঠিকাদারদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ অনেকটা ঘটা করে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান করে পরিবারের সবচেয়ে আদরের কন্যাকে বিদেশী বরের হাতে তুলে দেওয়ার শামিল। ফলশ্রুতিতে আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিদেশী কোম্পানীদের কাছে জিম্মি। আর যারা ডিজিটাল বংলাদেশ স্বপ্ন ও রুপরেখার কারিগর, যারা গত চল্লিশ বছর ধরে তিলে তিলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রসারে নিজেদের নিবেদিত করেছে তারা হচ্ছে উপেক্ষিত। 
 
আওয়ামী লীগ সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে গত বার বছরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পলিসি, কর ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে এখাতে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছে। সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা থেকে ২০০৮ সালে যেখানে মোট রপ্তানী আয় ছিল ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও নিচে সেখানে আজ আমাদের রপ্তানী ২০০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে আরো উর্ধ্বগামী। ইতিমধ্যেই প্রায় ডজেন খানেক তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপ ১০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক ভ্যালুয়েশনে আন্তর্জাতিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডসমূহ থেকে পুঁজি উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা আশাহত হই যখন বাজেট বক্তৃতায় ডিজিটাল বাংলাদেশ অংশে সরকারের বিভিন্ন ডিজিটাল উদ্যোগ সম্পর্কে বিশদ বর্ননা থাকলেও বেসরকারী খাতের ব্যাপক সাফল্যের কোন তথ্য এতে স্থান পায় না।
 
তদুপরী আমরা আশান্বিত যে স্থানীয় ডিজিটাল ডিভাইস ও সফটওয়্যাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বাজেটে আমদানী-নির্ভর পন্যসমূহের উপর শুল্ক ও কর প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে আমরা মর্মাহত যে লক্ষ কোটি টাকার উপর ব্যবসায়িক প্রণোদনা কার্যক্রমের ছিটেফোটাও যখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছায় না। 
 
করোনা অতিমারির দমকে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি বড় অংশ আজ বিলীয়মান। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বর্ধিষ্ণু হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বিদেশী কোম্পানীদের মোহাচ্ছন্ন হয়ে টেকসই উন্নয়নের অন্তরাল হয়ে দাড়িয়েছে। এই অবস্থার দ্রুত অবসান দরকার। সেই লক্ষ্যে বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ প্রণয়ন করা জরুরী এবং একই সাথে সকল উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অগ্রজ দরপত্রদাতা (প্রাইম বিডার) হিসেবে সুযোগ সৃষ্টির দিকনির্দেশনা নিশ্চিত করতে হবে। আর তা না হলে স্থানীয় অভিজ্ঞ তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের অনেকেই এ খাত ছেড়ে অন্য কোন ব্যবসায় বা পেশায় চলে যেতে বাধ্য হবেন। সেক্ষেত্রে ২০২৫ সালের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রপ্তানী লক্ষ্যমাত্রা সুদুর পরাহত হবে, ডিজিটাল বাংলাদেশ এর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে এবং সমগ্র যুবসমাজের ডিজিটাল স্বপ্ন ভুলন্ঠিত হবে।
 
নোট: আই.সি.টি়. বিভাগ উন্নয়ন বাজেট – ২০২১-২২ (প্রস্তাবিত) টাকা ১৩৬২ কোটি, ২০২০-২১ (সংশোধিত) টাকা ৬৬৭ কোটি; রাজস্ব বাজেট ২০২১-২২ (প্রস্তাবিত) টাকা ৩৫৮ কোটি, ২০২০-২১ (সংশোধিত) টাকা ৩৬৪ কোটি।
 
লেখক পরিচিতি:
হাবিবুল্লাহ্ এন. করিম, তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও প্রবক্তা। প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও টেকনোহেভেন কোম্পানি লিমিটেড।‌ সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ প্রাইম মিনিস্টার’স আইসিটি টাস্কফোর্স। বেসিসের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি জেনারেল ও দুইবারের নির্বাচিত সভাপতি। বাংলাদেশ আইসিটি পলিসি ২০০৯ এর ওয়ার্কিং গ্রুপ এর কনভেনর।
সমন্বয়ক, ব্লকচেইন অলিম্পিয়াড বাংলাদেশ।
কলামিস্ট দ্য ডেইলি স্টার এবং দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন এর ভাইস প্রেসিডেন্ট।
 

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন