কৃষি বিপ্লব ঘটাতো যাচ্ছে ডিজিটাল কৃষি

বিশ্বের জনসংখ্যা রীতিমত আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১২শ কোটিতে, এমন ভবিষ্যদ্বাণী করে রেখেছে জাতিসঙ্ঘ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে আবাদযোগ্য জমি দ্রুত কমে আসছে। ফলে অল্প জমিতে বেশি মানুষের জন্য খাবার ফলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে কৃষকদের। এ অবস্থায় নানা প্রযুক্তির সাহায্যে কৃষি ফলন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বটে, তবে পৃথিবীর মোট জমির পরিমাণ যেহেতু সীমিত এবং তাও ক্রমশ কমে আসছে, সেহেতু মানুষ বনাম জমি- এই দ্বৈরথ অতিক্রম করে সব মানুষের দু-বেলা খাবারের ব্যবস্থা করাটা এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চাইচ্ছে খাবার নিয়ে ভবিষ্যতের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে। এরকমই একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ক্লাইমেট কর্পোরেশন। দশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি চাইছে এমন কিছু ডিজিটাল আর্কিটেকচার টুল তৈরি করতে যেটি একটি কৃষি খামারে প্রতি মুহূর্তে কী ঘটে চলেছে তার হালনাগাদ তথ্য জানাবে। এ ব্যাপারে ক্লাইমেট কর্পোরেশনের সিইও মাইক স্টার্ন সিএনএনকে বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি ডাটা সায়েন্স-এর সাহায্যে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে। আমরা এমনভাবে কৃষি খামারের তথ্য সংগ্রহ করব, যেভাবে আমাদের সেলফোন বা আইপ্যাড ব্যবহার করে তথ্য জোগাড় করি।’ ক্লাইমেট কপোরেশনের জড়ো করা তথ্যগুলোকে ব্যবহার করার জন্য কৃষকদেরকে ব্যবহার করতে হবে একটি অ্যাপ। ফিল্ডভিউ ব্র্যান্ড নামে কিছু টুল তৈরি করেছে ক্লাইমেট কর্পোরেশন, যেগুলো কৃষকদেরকে নানা ধরনের জরুরি তথ্য প্রদান করবে, যেমন: গত চব্বিশ ঘণ্টায় কতটুকু বৃষ্টি হল, বাতাসে আর্দ্রতা কেমন ইত্যাদি। এছাড়াও ফিল্ডভিউ অ্যাপে আছে একটি বিশেষ ফিচার যার সাহায্যে আবহাওয়ার বর্তমান ও পুরনো তথ্য বিশ্লেষণ করে কৃষক বুঝতে পারবেন, কোন জমিটা এখন আবাদযোগ্য অবস্থায় আছে। আছে নাইট্রোজেন ট্র্যাকার নামে একটি ফিচার, যেটি কৃষককে জানাবে মাটিতে কোন পুষ্টি উপাদান প্রয়োগ করার দরকার আছে।

ফিল্ডভিউতে আরো ফিল্ড হেল্থ অ্যাডভাইজার নামে অতি প্রয়োজনীয় আরেকটি ফিচার যেটি ড্রোনের মাধ্যমে আকাশ থেকে তোলা ছবির সাহায্যে লাল ও সবুজ বিন্দুচিহ্নিত একটি ম্যাপ তৈরি করে (লাল হচ্ছে আশঙ্কাজনক এলাকা আর সবুজ হচ্ছে ভালো)। এই মানচিত্রের মাধ্যমে কৃষকরা বুঝতে পারবেন তাঁদের শষ্যক্ষেত্রের কোথায় শস্যগুলো ঠিকমত বেড়ে উঠছে আর কোথায় বাড়ছে না। আর এভাবেই তাঁরা কোন ক্ষেতে বেশি যত্ন নিতে হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এই সুবিধাটির ব্যাপারে স্টার্ন বলেন, ‘আপনার যদি বিশ, ত্রিশ বা চল্লিশটি ক্ষেতও থাকে, তাহলেও আপনি সবগুলোর খোঁজখবরই রাখতে পারবেন। আপনি জানতে পারবেন, কোথায় কোন সমস্যা আছে এবং কীভাবে সেটি মোকাবেলা করতে হবে।’ এই প্রযুক্তির সাহায্যে কৃষক ক্ষেতে পানি দেয়া, বীজ বপন করা এবং শস্য আহরণ করার ব্যাপারেও নিয়ে পারবেন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।

ক্লাইমেট কর্পোরেশন নামের এই প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা হচ্ছে মনসানটো ( Monsanto ) নামের একটি প্রতিষ্ঠানের, যেটি জিএম ফুডের কারণে অনেকের সমালোচনার শিকার হয়েছে। ২০১৩ সালে ক্লাইমেট কর্পোরেশনকে কিনে নেয় মনসানটো, আর তখন থেকেই সমালোচকদের মন জয়ের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। ক্লাইমেট কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠানের জন্ম ২০০৬ সালে, গুগলের দুই সাবেক কর্মীর হাতে। আর তাদেরই একজন স্টার্ন। তিনি জানান, ক্লাইমেট কর্পোরেশন-এর লক্ষ্য হচ্ছে কৃষিকাজের বাধাগুলো সরিয়ে নিয়ে এটিকে যতটাসম্ভব স্থায়িত্বশীল করা। তিনি ভুট্টাজাতীয় শস্যের উদাহরণ দিয়ে জানান, প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষি কীভাবে খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা জোগাতে পারে। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের খামারগুলোতে বাস্তবে যেখানে প্রতি একরে ৫৩০ বুশেল ভুট্টা উৎপাদন করা সম্ভব, সেখানে সেদেশের জাতীয় গড় মাত্র ১৬৮ বুশেল। তিনি মনে করেন, ডিজিটাল কৃষির মাধ্যমে এই উৎপাদনকে কাম্য মাত্রার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এটি যে পরিপূর্ণভাবে, অর্থাৎ একশো ভাগই করা সম্ভব তা অবশ্য ক্লাইমেট কর্পোরেশন বলে না। তিনি বলেন, ‘পুরোপুরি কাম্য মাত্রায় পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এটিকে অনেকটাই বাড়ানো সম্ভব, যা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামলানোর জন্য যথেষ্ট।’ ক্লাইমেট কর্পোরেশন-এর প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক কৃষকই তাঁদের খামারের উৎপাদন বাড়িয়েছেন। এমন একজন কৃষক কিথ গিংরিচ জানান, তিনি মূলত ভুট্টা আর সয়াবিন উৎপাদন করেন। ফিল্ডভিউ প্রযুক্তির মাধ্যমে হালনাগাদ তথ্যগুলো সহজে হাতে পাওয়ার মাধ্যমে তাঁর খামারের উৎপাদন গত কয়েক বছরে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি জানান। গিংরিচ আরো জানান, তিনি প্রতিদিনই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। তিনি ফিল্ডভিউ হিটম্যাপ ব্যবহার করে খামারের কোন কোন জমির বেশি দেখভাল করা দরকার তা জেনে নেন। এর ফলে কর্মপ্রক্রিয়া সহজতর হয় এবং প্রচুর সময় বাঁচে। গিংরিচ বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে দুনিয়ার মানুষের খাবার জোগানো। কাজেই অল্প জায়গায়, অল্প পানি ও পুষ্টি উপকরণ ব্যবহার করে কীভাবে আরো বেশি খাবার উৎপাদন করা যাবে সেটি জানা আমাদের খুবই দরকার।’

ক্রমবর্ধমান মানুষের চেপে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসা কৃষিজমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর আসলেই কোনো বিকল্প নেই। আর এজন্য সিংহভাগ কৃষকই এখন কোনো না কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ক্লাইমেট কর্পোরেশন কৃষকদের নাগালের মধ্যে দামে তাদের প্রযুক্তিকে পৌঁছে দিতে একেবারে ফ্রি ভারশন থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে প্রায় দেড় হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়ে থাকে- যদিও প্রযুক্তিটির দাম বহুলাংশেই নির্ভর করবে খামারের আকার এবং কোন কোন ফিচার ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর।

টেকইকম ডেক্স

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন