সরকারের সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পাওনা নিয়ে আর কতো ‘ফন্দি-ফিকির’ গ্রামীণফোনের!

গ্রামীণফোন
গ্রামীণফোন

টেকভিশন২৪ ডেস্ক: অডিট আপত্তিতে গ্রামীণফোনের কাছে বিটিআরসির পাওনা দাবির সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার সাড়ে ১০ হাজার কোটিই এখনও অনাদায়।

পেরিয়ে গেছে ৪ বছর, সেই ২০১৯ সালের শুরুতে যখন বিটিআরসি পাওনা দাবি করে এরপর ওই পাওনাকে অন্যায্য, অযৌক্তিক প্রতিষ্ঠিত করতে কিই না করেছে অপারেটরটি। পর্যায়ক্রমে দেশের আদালতে যাওয়ার পাশাপাশি অপারেটরটি তাদের বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানিতে যাওয়ার বিষয়ে একটি নোটিসও সরকারকে পাঠিয়েছিলো। এমনকি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেও ‘উকিল নোটিশ’ পাঠানোর মতো কাণ্ড করেছিলো অপারেটরটির মূল কোম্পানি টেলিনর।

আর এই পাওনা নিয়ে এখনও নানা ‘ফন্দি-ফিকির’ করে যাচ্ছে গ্রামীণফোন। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি গ্রামীণফোন বিটিআরসিকে চিঠি দেয় এই অডিট আপত্তির ‘মধ্যস্থতা’ নিয়ে আলোচনার জন্য। আর এর দুই মাস আগে অপারেটরটি আদালতে আবেদন করে যে, বিটিআরসির সঙ্গে মধ্যস্থতার জন্য তাদের আরও সময় প্রয়োজন।

নীতি-নির্ধারক ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসলে কতো সময় প্রয়োজন ? অপারেটরটির ২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের পর বাকি পাওনা নিয়ে মধ্যস্থতা করতে দুই বছর সময় পেরিয়ে গেলো !

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলছেন, ‘যখনই রাষ্ট্রের কোনো পাওনা দাবি আসে তারা নানা অজুহাত দিয়ে দুটি চেষ্টা করে, একটা হলে বিলম্ব করা আর দুই হলো কমানো যায় কিনা। দেন-দরবার-তদবির হতে শুরু করে এমন কোনো চাপ নেই যে, তারা দেয় না। অডিটের টাকা যখন আদায় করি তখন কল্পনার বাইরে তারা চাপ দিয়েছে।

’‘কিন্তু আমরা আইনের বাইরে যেতে পারি না। ওরা যখন নানাভাবে সময় ক্ষেপণ করার চেষ্টা করে কিংবা আদালতে যায় যখন সিস্টেমের মধ্য দিয়ে আমাদের চলতে হয়। তবে আমরা সরকারি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে চুল পরিমাণ ছাড় দেইনি, দেবোও না’ বলছিলেন মন্ত্রী।

বিটিআরসিতে মধ্যস্থতার জন্য করা আবেদনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিটিআরসি সাড়া দেয়নি। গ্রামীণফোন বলছে, তাদের মামলায় সিপিসি ৮৯ ধারায় আপোষের বিধান আছে । কিন্তু বিটিআরসি বলছে, গ্রামীণফোন ওই ধারার বিধান অনুযায়ী তাদের কাছে আবেদনই করেনি। তাই মধ্যস্থতার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে বিটিআরসি।

গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশনস খায়রুল বাশার বলেন, ‘গ্রামীণফোন বরাবরই গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী। বিটিআরসির ইস্যুকৃত অডিট সংক্রান্ত দাবিটি বর্তমানে বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট আইনে (দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ধারা ৮৯ ক) বিচারাধীন বিষয়ে পক্ষদের মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। সেই অনুযায়ী গ্রামীণফোন অডিট বিরোধটির একটি স্বচ্ছ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধানকল্পে বিটিআরসির সাথে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিস্পত্তির লক্ষ্যে আইনসিদ্ধ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।’

এদিকে গ্রামীণফোনের আবেদনে এই অডিট পাওনা ইস্যু মধ্যস্থতার জন্য ২০২৩ সালের ২২ জুন তারিখ ধার্য রেখেছেন আদালত। এখন এই সময়ের মধ্যে অডিট আপত্তির বিপুল টাকা পাওনা দাবি নিয়ে গ্রামীণফোনের কোনো আলোচনা কিংবা কাউকে মধ্যস্থতাকারী করার প্রস্তাব যদি বিটিআরসি রাষ্ট্রীয় স্বার্থে না গ্রহণ করে আবার বিটিআরসির দাবির বিষয়ে গ্রামীণফোন নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তা গ্রহণ না করে-তাহলে কী হবে ?

যা ঘটেছে :

গ্রামীণফোনের জন্ম থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অডিট করে বিটিআরসি। বেসরকারি অডিটদের করা ওই নিরীক্ষায় অপারেটরটির কাছে ১২ হাজার ৫৯৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা কমিশনের পাওনা বলে উঠে আসে।

২০১৯ সালের শুরুর দিকে ওই টাকা দাবি করে কমিশন গ্রামীণফোনকে চিঠি দেয়। গ্রামীণফোন শুরু থেকেই এই দাবিকে অযৌক্তিক বলতে শুরু করে। এরপর তারা বলে তাদের কাছ থেকে জাের করে টাকা নিতে চাইছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অন্যদিকে টেলিযোগাযোগ বিভাগ ও বিটিআরসি অপারেটরটির এই বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য বলে।

পর্যায়ক্রমে দেশের আদালতে যাওয়ার পাশাপাশি অপারেটরটি তাদের বিনিয়োগকারীদরে মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানিতে যাওয়ার বিষয়ে একটি নোটিসও সরকারকে পাঠায়। এমনকি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেও ‘উকিল নোটিশ’ পাঠায় অপারেটরটির মূল কোম্পানি টেলিনর।

এসবের আগে টাকা দাবি করার পর থেকে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। এর মধ্যে ব্যন্ডউইথ কমিয়ে দেওয়া এবং ২২ জুলাই থেকে অপারেটি যাতে আর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নতুন সেবা নিয়ে আসতে না পারে সে জন্য তাদের সব অনুমোদন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অডিট সংক্রান্ত এ সমস্যা সমাধানে প্রথমে অর্থমন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা আলাদা পদক্ষেপ নিলেও তাতে সমস্যার সুরাহা হয়নি।

শেষে ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর আপিল বিভাগ গ্রামীণফোনকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দাবি করা ১২ হাজার ৫৯৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকার মধ্যে দুই হাজার কোটি টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে এ আদেশ দেন।আদেশে বলা হয়, নির্ধারিত সময় তিন মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করতে পারলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে বিটিআরসি।

এরপর এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি রিভিউ আবেদন করে অপারেটরটি। এতে তারা ৫৭৫ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করে, যা তারা এক বছরে সমান বারোটি কিস্তিতে পরিশোধ করতে চাইছিল তারা। তবে আবেদনে ওই প্রস্তাব আমলে নেয়নি উচ্চ আদালত।

পরে বছরটির ফেব্রুয়ারিতে ওই রিভিউ আবেদনের শুনানি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত গ্রামীণফোনকে বলেন, আগে বিটিআরসিকে ১০০০ কোটি টাকা দিয়ে আসুন এরপর পরবর্তী আদেশ দেয়া হবে।

এরপর ওই বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসিকে ১০০০ কোটি টাকা দেয় গ্রামীণফোন। এর একদিন পর ২৪ ফেব্রুয়ারি রিভিউ আবেদনের রায়ে আপিল বিভাগ গ্রামীণফোনকে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে বিটিআরসিকে আরও এক হাজার কোটি টাকা দিতে বলেন।

এরপর গ্রামীণফোন ওই ১০০০ কোটি টাকাও পরিশোধ করে।

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন