বাজেটে প্রযুক্তি খাতের বিদ্যমান সুবিধা ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত বহাল রাখা প্রয়োজন

বাজেটে
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির পরিচালক ও স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম

দেশের তথ্য প্রযুক্তি খাতের বিকাশে আসন্ন বাজেটে কি ধরনের নীতি সহায়তা আশা করছেন এ খাতের উদ্যোক্তার— এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির পরিচালক ও স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম

প্রযুক্তি  কম্পিউটার খাতের উদ্যোক্তা হিসেবে আসন্ন বাজেটে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

প্রথমত, আমরা চাই সরকার দেশীয় সফটওয়্যারের উন্নতিতে মনোযোগ দিক। আমাদের দেশে বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা দেশে বসে আন্তর্জাতিক অনেক সফটওয়্যার তৈরি করছে। বিপরীতে দেদারসে মানুষ বিদেশী সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। কিন্তু দেশেও মানসম্পন্ন সফটওয়্যার রয়েছে। এগুলোর প্রচারণা ও সরকারি সহযোগিতা পেলে দেশের বাজারে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারবে। এতে বিদেশী সফটওয়্যার কিনতে গিয়ে বাড়তি ডলার খরচ হবে না। অন্যদিকে দেশীয় সফটওয়্যার উৎপাদকরা লাভবান হবেন। দেশীয় এসব সফটওয়্যার রফতানি করতে পারলে একটি বড় সম্ভাবনা তৈরি হবে এ খাতে।

প্রযুক্তি খাতে সরকারের দেয়া বিদ্যমান সুযোগসুবিধায় এবারের বাজেটে কোনো সংযোজন প্রয়োজন আছে কি?

বর্তমানে যেসব সুবিধা দেয়া আছে, এগুলো যেন অন্তত ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত বহাল থাকে এবং করপোরট ট্যাক্স আরো কমিয়ে আনা প্রয়োজন। এসব বিষয়ে আমরা এনবিআরকে চিঠি দিয়েছি। আলোচনায় বসতে চেয়েছি বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির পক্ষ থেকে। কিন্তু তারা ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারেনি। তবে আমরা বিষয়গুলো তাদের জানিয়েছি।

বাংলাদেশী ব্র্যান্ডের কম্পিউটার বা হার্ডওয়্যার পণ্যের কারখানা তৈরি কতটা জরুরি?

কর্মসংস্থানের বিষয়ে যদি বলি, তাহলে দেখা যায় হার্ডওয়্যার পণ্যের চেয়ে সফটওয়্যারে দেশের লাভ বেশি। কারণ কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা অন্য প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আমাদের এখানে নেই। এটি আমদানি করতেই হবে। অন্যদিকে আমাদের এখানে বিশাল জনশক্তি রয়েছে। এটিকে কাজে লাগাতে হবে। পোশাক শিল্পে শ্রমিকের মূল্য সংযোজন প্রায় ৪০ শতাংশ। কিন্তু কম্পিউটার বা আইটি পণ্যে এটি ১-২ শতাংশ। তাই এখানে আইটি পণ্য উৎপাদন করে দেশের কোনো উপকার হবে বলে আমি মনে করছি না। সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আমরা যদি আইটি পণ্যের কোর ম্যানুফ্যাকচারার ফর দ্য স্পেয়ার পার্টস তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশে আনতে পারি, তাহলে সেটি আমাদের উপকারে আসবে। এটি করতে হবে সরকারকে। এখানে যদি কম্পিউটার বা হার্ডওয়্যার প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন করি আর ৯৯ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, তাহলে দেশের কিছুই ব্যবহার হলো না। আবার শ্রমিকও খুব একটা প্রয়োজন হচ্ছে না। ফলে দেশের খুব একটা লাভ হচ্ছে না। ডিউটি বাড়লে ফিনিশড প্রডাক্টের দামও বাড়বে। আবার ফিনিশড প্রডাক্ট উৎপাদনের জন্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে স্পেয়ার পার্টস কিনতে ১০ শতাংশ বেশি খরচ হচ্ছে। এতে দেশ থেকে ডলার বেশি খরচ হয়ে গেল। ফলে দামও বাড়বে প্রযুক্তিপণ্যের। তখন প্রান্তিক মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে আইটি পণ্য। তাই কম্পিউটার সমিতি থেকে আমাদের আকুল আবেদন, কাস্টমস ডিউটি যেন বাড়ানো না হয়। স্থানীয় উৎপাদকের জন্য এরই মধ্যে সুবিধা দেয়া আছে। আর প্রয়োজন নেই।

প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনে কর্মসংস্থান তৈরিতে সরকারের কী উদ্যোগ প্রয়োজন?

ল্যাপটপ, কম্পিউটার বা হার্ডওয়্যার পণ্যের কারখানায় শ্রমিকের চাহিদা বড় আকারে নয়। কারণ এসব কারখানা মূলত অটোমেটেড ও সংক্ষিপ্ত। তাই এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ খুব বেশি নেই। অন্যদিকে সফটওয়্যার উৎপাদনে প্রচুর দক্ষ জনবল বা প্রকৌশলী প্রয়োজন। এ খাতে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। তাই এবারের বাজেটে এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে প্রযুক্তি খাতে সুযোগ-সুবিধা দেয়া উচিত।

কম্পিউটারসহ প্রযুক্তিপণ্য প্রান্তিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হলে এবারের বাজেটে কী পদক্ষেপ প্রয়োজন?

বাংলাদেশে উৎপাদন করতে গেলে একেকটা আইটেম উৎপাদনের পদ্ধতি ভিন্ন। দেখা যাচ্ছে একটি ল্যাপটপ আমদানিতে যে খরচ, কাঁচামাল আমদানি করে এখানে উৎপাদন করতে গেলে খরচ ১০ শতাংশ বাড়তি পড়ছে। এখন সরকার যদি এখানে ল্যাপটপ আমদানির ওপর বাড়তি কর আরোপ করে এবং কাঁচামাল আমদানিতে কর অব্যাহতি দেয়, তাহলে দেখা যাবে কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে। কিন্তু এতে দেশের ক্ষতি। একটি ল্যাপটপ আন্তর্জাতিক বাজারে যে মূল্য, সেটি যদি কাঁচামাল আমদানি করে দেশে তৈরি করা হয়, তাহলে দেখা যাবে এটিতে ১০ শতাংশ বেশি খরচ পড়ছে। তাহলে দেশীয় ব্র্যান্ড তৈরি করতে গিয়ে একটি কম্পিউটার ১০ শতাংশ বাড়তি টাকায় কিনতে হচ্ছে উদ্যোক্তাকে। এতে দেশের বাজারে ল্যাপটপের তুলনায় দেশে তৈরি করা ল্যাপটপের দাম কিছু কম মনে হলেও আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় সেটি অনেক বেশি। তাই এ খাতে উৎপাদনে না গিয়ে আমার মতামত ল্যাপটপ কম্পিউটার আমদানিই যৌক্তিক হবে। তাহলে দেশের টাকা অপচয় হবে না। দামও অস্বাভাবিকভাবে বাড়বে না।

তাহলে হার্ডওয়্যার পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করণীয় কীশুধুই আমদানিনির্ভরতানাকি অন্য কোনো পথ?

অন্য পথ বলতে এখানে সেমিকন্ডাক্টর ও প্রযুক্তিপণ্যের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা প্রয়োজন। ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলো কিন্তু সেমিকন্ডাক্টর কারখানার দিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় চিপ উৎপাদনের জন্য ইন্টেল বড়সড় বিনিয়োগ করছে। উন্নত দেশগুলো সরাসরি কম্পিউটার উৎপাদনে যাওয়ার চেয়ে চিপ উৎপাদনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের এখানে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ তুলনামূলক কম রয়েছে। সে তুলনায় অনেক বেশি জনশক্তি রয়েছে আমাদের দেশে। বিশাল এ জনশক্তি কাজে লাগাতে না পারলে সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।

যেকোনো পণ্যে আমদানির বিকল্প তৈরি করতে গিয়ে আমদানির চেয়ে বেশি খরচ হলে তা দেশের জন্যই আর্থক ক্ষতির কারণ হবে। এতে পণ্যের মূল্য যেমন বাড়বে, তেমনি দেশের অর্থ ও সময় অপচয় হবে। তাই যেকোনো পণ্য উৎপাদনে যাওয়ার আগে সঠিকভাবে হিসাব করে দেখতে হবে, সেটা আন্তর্জাতিক বাজারের বিবেচনায় দেশের জন্য লাভজনক হয় কিনা। দিনশেষে দেশের স্বার্থটাই আমাদের বড় করে দেখা উচিত। – বণিক বার্তা

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন