বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) আয়োজিত ষষ্ঠতম বার্ষিক “গণশুনানি ২০২৫” সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে দেশীয়ভাবে তৈরি ভিডিও কনফারেন্সিং ও কলাবোরেশন প্ল্যাটফর্ম ‘কনভে’ ব্যবহার করে।
টেকভিশন২৪ ডেস্ক: বিটিআরসির পূর্ববর্তী গণশুনানিগুলো মূলত রাজধানীকেন্দ্রিক সশরীরে আয়োজন ছিল যেখানে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগকেই নির্ধারিত স্থানে এসে উপস্থিত থাকতে হতো। কোভিড–পরবর্তী সময়ে কিছু গণশুনানিতে সীমিত আকারে লাইভ স্ট্রিমিং বা অনলাইন সংযুক্তির ব্যবস্থা থাকলেও পুরো প্রক্রিয়া—নিবন্ধন, অংশগ্রহণকারীর প্রশ্ন, মাইক্রোফোন ম্যানেজমেন্ট, সময় ব্যবস্থাপনা ও নথিভুক্তি—মূলত অফলাইন ব্যবস্থাপনাকেই কেন্দ্র করে পরিচালিত হতো। তবে, বিটিআরসির এবছরের ষষ্ঠতম গণশুনানিটি প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ অনলাইন অংশটি পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্বভাবে তৈরি সুরক্ষিত ভিডিও কনফারেন্সিং ও কলাবোরেশন প্ল্যাটফর্ম “কনভে” ব্যবহার করে।
গত ২৫শে নভেম্বর, মঙ্গলবার সকাল ১০টায় রাজধানীর বিটিআরসি ভবনে এ গণশুনানি শুরু হয়। বিটিআরসি’র এ গণশুনানিতে সরাসরি উপস্থিতির পাশাপাশি দেশের নানা প্রান্ত থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অংশগ্রহণকারী যুক্ত হন অনলাইনে। যেখানে উপস্থিত ছিলেন বিটিআরসির চেয়ারম্যান, কমিশনের সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন বিভাগের মহাপরিচালক ও পরিচালকবৃন্দ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিনিধি, মোবাইল অপারেটর ও ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী (আইএসপি) প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কেবল অপারেটর সংগঠনের প্রতিনিধি, ভোক্তা অধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরগণ। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে ভোক্তা ও সাধারণ নাগরিকেরা কনভে প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনলাইনে গণশুনানিতে যুক্ত হন।
গণশুনানিতে অংশ নেওয়ার জন্য বিটিআরসি তাদের অফিসিয়াল নোটিশে, আগ্রহী অংশগ্রহণকারীদের জন্যে অনুষ্ঠান শুরুর প্রায় ৩০ মিনিট আগে কনভে–তে যোগদানের লিংক শেয়ার করে, যা সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। নির্ধারিত সময়ে সবাই ওই লিংকে প্রবেশ করে অনলাইন সেশনে যোগ দেন এবং সেখান থেকেই মূল গণশুনানির ভার্চুয়াল অংশ পরিচালিত হয়। নিবন্ধনের পর নির্ধারিত সময়ে তারা লগইন করেন কনভে প্ল্যাটফর্মে, যুক্ত হন মূল সেশনে, এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কথা বলার সুযোগ পান।
গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা মোবাইল নেটওয়ার্কের মান, কলড্রপ, ইন্টারনেট সেবার গতি ও স্থিতিশীলতা, কলরেট, ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (ভিএএস), অবাঞ্ছিত এসএমএস এবং বিভিন্ন ডিজিটাল সেবাজনিত ভোগান্তি ইত্যাদি বিষয়ে অভিযোগ ও মতামত তুলে ধরেন। তারা গ্রামীণ ও শহুরে এলাকার নেটওয়ার্ক ব্যবধান, উচ্চগতির ইন্টারনেটের প্রাপ্যতা, গ্রাহকসেবা কেন্দ্রের সাড়া পাওয়া, ডেটা প্যাকেজের কাঠামো এবং বিলিং–সংক্রান্ত নানা সমস্যার কথাও উল্লেখ করেন।
বিটিআরসি’র সংশ্লিষ্ট সদস্যরা একদিকে অনলাইনে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশ্নের জবাব দেন, অন্যদিকে প্রাপ্ত অভিযোগ ও প্রস্তাবগুলোকে নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রক সংস্কারের কাজে ব্যবহার করার লক্ষ্যে নথিবদ্ধ করেন।
এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে সহজ, সুশৃঙ্খল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলেছে ব্যাকএন্ডে কাজ করা কনভে প্ল্যাটফর্ম—যেখানে উপস্থিতদের প্রশ্নের সারি, লাইভ নোট ও রেকর্ডিং সব সমন্বিতভাবে কাজ করেছে।
গণশুনানি আয়োজনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরেই ভোক্তা ও সাধারণ মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে বিটিআরসি। কিন্তু এই ষষ্ঠতম গণশুনানিতে শুধু রাজধানী-কেন্দ্রিক সরাসরি উপস্থিতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, দেশের দূরতম প্রান্তের মানুষও প্রথমবারের মতো একটি দেশীয় অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সরাসরি গণশুনানিতে কথা বলার সুযোগ পেলেন।
বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, গণশুনানির লক্ষ্য ছিল সারাদেশের ভোক্তাদের মতামত ও অভিযোগ সরাসরি শোনা, সেগুলো নীতিনির্ধারণে বিবেচনায় নেওয়া এবং নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে আরও অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ করা। এভাবে অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তুলবার যে লক্ষ্য বিটিআরসি সামনে নিয়ে এগোচ্ছে, এ বছরের ষষ্ঠতম গণশুনানি তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত প্রযুক্তি দায়িত্বশীলরা জানান, পুরো সময়জুড়ে কনভে প্ল্যাটফর্মে অডিও ও ভিডিও সংযোগ স্থিতিশীল ছিল এবং মডারেশন প্যানেলের মাধ্যমে প্রশ্নোত্তর পর্ব সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে। স্পিকার নির্বাচন, মাইক্রোফোন অন–অফ নিয়ন্ত্রণ, সময় ব্যবস্থাপনা ও অংশগ্রহণকারীদের কিউ–ম্যানেজমেন্ট একই প্ল্যাটফর্মের ভেতর থেকে করা হয়েছে। গণশুনানির পুরো কার্যক্রম পরবর্তী বিশ্লেষণ ও নথিভুক্তির জন্য রেকর্ড করা হয়।
দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিনেসিস আইটি পিএলসি তৈরি করেছে কনভে প্ল্যাটফর্মটি। কনভে একটি সার্বভৌম ভিডিও কনফারেন্সিং সল্যুশন, যেখানে প্ল্যাটফর্মে ব্যবহৃত সব ধরনের ডেটা দেশের ভেতরেই নির্ধারিত অবকাঠামোতে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। ব্যবহারকারীর অডিও–ভিডিও, চ্যাট, লগ ও রেকর্ডিংসহ সব তথ্য বাংলাদেশের আইনগত এখতিয়ারের মধ্যে থাকে বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
নিরাপত্তার প্রশ্নে কনভে–তে রয়েছে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন, ভূমিকা–ভিত্তিক (role-based) অ্যাকসেস কন্ট্রোল, মাল্টিফ্যাক্টর অথেনটিকেশন–সহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। বড় আকারের সভা, গণশুনানি বা নীতি–সংলাপ আয়োজনের জন্য একসঙ্গে কয়েক হাজার অংশগ্রহণকারী যুক্ত হয়ে সেশন পরিচালনা করার সক্ষমতাও রয়েছে প্ল্যাটফর্মটিতে। সরকারি ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট আয়োজনের কথা বিবেচনা করে কনভে–তে সংযোজিত হয়েছে কিছু বিশেষ ফিচার—যেমন বিল্ট-ইন চ্যাট, Q&A, সেশন রেকর্ডিং, স্পিকার ও অংশগ্রহণকারী ম্যানেজমেন্ট, ওয়েটিং রুম, এবং মডারেশন টুলস। এসব ফিচারের কারণে আয়োজকদের জন্য বড় পরিসরের অনলাইন সেশনও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা সহজ হয়েছে বলে জানানো হয়।
বিটিআরসি গণশুনানি ২০২৫–এর আগে দেশের বাইরে ও ভেতরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছে কনভে। চলতি বছর ২৬-২৭ মে, দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত জি–২০ “SIDSSA ২০২৫” সিম্পোজিয়াম–এর সরকারি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কনভে নির্বাচিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি এইচ. ই. সিরিল রামাফোসা’র নেতৃত্বে কনভের ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে অংশ নিয়েছেন ২৭ দেশের মন্ত্রী, কূটনীতিক, নীতিনির্ধারক এবং বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা। সাধারণত এ ধরনের অনুষ্ঠানে জুম (Zoom) বা গুগল মিট (Google Meet)–এর মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহৃত হলেও এবার বাংলাদেশে তৈরি একটি প্ল্যাটফর্মকে সরকারি ভার্চুয়াল ভেন্যু হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
এছাড়া জাতীয় জলবায়ু অর্থায়ন (Climate Finance) বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতেও অনলাইন অংশীদার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কনভে। রাজধানীর পরিকল্পনা বিভাগে আয়োজিত হাইব্রিড মোডের ওই সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও সুইডেনের দূতাবাসের প্রতিনিধিরা এবং ইউএনডিপি, জিসিএফ, সিভিএফ, ভি২০, আইআইএক্স, এফসিবিও, ও জিএ ক্যাপিটালের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। এ ছাড়াও কনভেতে ৯০০ জনের বেশী অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে অনলাইনে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিটি সম্পন্ন হয়। এছাড়াও, অন্যদিকে আফ্রিকার আফ্রিমাস (Afrimass) এর অনলাইন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিটিও কনভের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়।
এসব অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বজায় রেখেই বড় আকারের অনলাইন সভা ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা সম্ভব কনভে প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে।
বিটিআরসি গণশুনানি ২০২৫–এ কনভে ব্যবহারের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের অভিমত, বড় পরিসরের সরকারি সভা, জনপরামর্শমূলক কার্যক্রম ও নীতি–সংলাপ আয়োজনের জন্য এখন দেশীয় প্রযুক্তি–নির্ভর সমাধানের ওপর আরও বেশি আস্থা রাখা সম্ভব। ভোক্তার মতামত সংগ্রহ থেকে শুরু করে অভিযোগ ব্যবস্থাপনা ও নীতিগত আলোচনার প্রতিটি ধাপেই স্থানীয়ভাবে হোস্ট করা একটি নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের ফলে ডেটা–সংক্রান্ত ঝুঁকিও কমে আসে।
এ ধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে, সরকার ও বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা যখন নিজেদের কাজের প্রক্রিয়ায় দেশীয় প্রযুক্তি সমাধানকে যুক্ত করছে, তখন ডিজিটাল শাসনব্যবস্থার একটি বাস্তব প্রয়োগ সামনে আসছে। ভোক্তা ও নাগরিকদের অংশগ্রহণ, স্থানীয় প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ডেটা সার্বভৌমত্ব—এই তিনটি দিক একসঙ্গে নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিটিআরসি গণশুনানি ২০২৫ এবং কনভে প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সবশেষে বলা যায়, বিটিআরসি’র ষষ্ঠ গণশুনানি কেবল নিয়মিত বার্ষিক আয়োজন হিসেবেই নয়, বরং প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ অনলাইন অংশ দেশীয় প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিচালনার দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে সরকারি দপ্তর, স্বশাসিত সংস্থা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বড় পরিসরের অনলাইন সভা, শুনানি ও পরামর্শমূলক কার্যক্রমে দেশীয় প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও বাস্তব দিশা দেবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।


