মূলত বাবা-মায়ের শখ এবং ইচ্ছা থেকেই আমাদের ব্যবসার পরিধি বাড়াই : নাভিদুল হক

নাভিদুল হক

টেকভিশন২৪.কমএর নিয়মিত আয়োজন ‘টেক ইন্টারভিউ’। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসা, সফলতা-ব্যর্থতা এবং অনুপ্রেরণামূলক নানান বিষয় নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় এ বিভাগে।

এবারের আয়োজনের অতিথি ‘মোহাম্মদী গ্রুপে’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাভিদুল হক। বাংলাদেশে সুপরিচিত এবং নানান পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক হালচাল এবং দেশের আইটি, সফটওয়্যার শিল্প এবং ওটিটি বিজনেসসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন টেকভিশন২৪.কম নিউজ পোর্টালের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মো. গোলাম দাস্তগীর তৌহিদ।

টেকভিশন২৪: শুরুতেই আপনার শিক্ষাজীবন এবং একজন ব্যক্তি নাভিদুল হক সম্পর্কে জানতে চাই।নাভিদুল হক: আমি ধানমন্ডি টিউটোরিয়াল স্কুলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ি। সেটা ছিল ও-লেভেল, এ-লেভেল স্কুল। তারপর ভর্তি হই বারিধারা আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। ২০০২ সালে আমেরিকান সিস্টেমে ‘টুয়েলভ গ্রেড’ মানে এইচএসসি শেষ করে চলে যাই আমেরিকা। সেখানে আমি বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট ও সিআইএস–এ গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছি ২০০৬ সালে। ভবিষ্যতে সময় পেলে মাস্টার্স করার ইচ্ছে আছে। ছোটবেলায় আমাদের পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে কিছুটা যুক্ত হয়ে যাই। ৯০–এর দশকে দেশে প্রথম যখন কম্পিউটার আসে, তখনই আমার কম্পিউটারে হাতেখড়ি হয়। তাই স্কুলজীবনে কম্পিউটার বিষয়ে জানার কারণে বাবা-মায়ের অফিসে কম্পিউটারের কিছু কাজে সহযোগিতা করতাম। আর এভাবেই বাবা-মায়ের ব্যবসার সঙ্গে আমার যুক্ত হওয়া।

পরিবারের সাথে নাভিদুল হক।

টেকভিশন২৪: আপনি বাংলাদেশের সু-প্রতিষ্ঠিত শিল্প–প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের জানামতে, আপনার ব্যবসায়িক জীবন শুরু হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসার মাধ্যমে। সেই গল্পটা শুনতে চাই।
নাভিদুল হক
: আসলে মোহাম্মদী গ্রুপ আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। আমার বাবা তাঁর কয়েকজন পার্টনার মিলে আশির দশকে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পরে আমার মা–ও ৯০–এর দিকে এই ব্যবসায় সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তীতে, ২০০০ সালের দিকে পার্টনারদের সঙ্গে বাবার ব্যবসা ভাগ হয়ে যায়। বাবা–মা চাইতেন তাদের সন্তানেরাও যেন ব্যবসায় যুক্ত হয়। আমি ২০০৬ সালের দিকে পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত হই। এছাড়া ৯০–এর দশকে আমাদের তৈরি–পোশাক ব্যবসার পাশাপাশি অন্য ব্যবসার কথা ভাবেন বাবা। সেই চিন্তা থেকেই তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবসা শুরু করেন। মূলত বাবা–মায়ের শখ এবং ইচ্ছা থেকে তৈরি–পোশাক খাতের পাশাপাশি অন্য খাতে আমাদের ব্যবসার পরিধি বাড়াই। আইটি, মিডিয়া এবং পাওয়ার সেক্টরে কাজ শুরু করেছি। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি ও আমার বোনরাই ব্যবসা দেখাশোনা করছি। মা আছে আমাদের উপরে ছায়ার মত।

টেকভিশন২৪: সুপরিচিত তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টেকনোভিসতার পরিচালক আপনি। আপনাদের প্রতিষ্ঠানের তৈরি সফটওয়্যার বর্তমানে কোন কোন দেশে রপ্তানি করছেন? এছাড়া বাংলাদেশের সফটওয়্যারের বাজারে আপনাদের প্রতিষ্ঠান কত শতাংশ অটোমেশন বা সফটওয়্যার সেবা দিচ্ছেনাভিদুল হক: ৯০ দশকের শেষে বাংলাদেশে আসলে সেভাবে সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি ছিল না। বড় ব্যবসায়িক গ্রুপগুলো ছাড়া তখন দেশের মানুষও সেভাবে সফটওয়্যার ব্যবহার করতো না। হয়তো এক-দুটা কম্পিউটার ছিল টাইপিং বা ই-মেইলের জন্য। সেসময় আমরা শুরু করি। আমাদের ইচ্ছে ছিল বিদেশ থেকে, বিশেষ করে ভারত থেকে ভালো ভালো সফটওয়্যার যেমন হাসপাতাল–ব্যবস্থাপনা অথবা ইআরপি—এ ধরনের সফটওয়্যার এনে স্থানীয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেগুলো ইমপ্লিমেন্ট করা অথবা কিছু কাস্টমাইজড সফটওয়্যার তৈরি করা। এভাবেই, ১৯৯৯ সালের আমরা শুরু করেছিলাম টেকনোভিসতা।

কয়েক বছর যাওয়ার পর দেখলাম, স্থানীয় বাজার প্রস্তুত হয়নি। আমরা ছোটোখাটো কিছু প্রোডাক্ট তৈরি করেছিলাম। ২০০৫–এর দিকে আমরা ই-গভর্ন্যান্স সফটওয়্যারে চলে যাই। তখন সরকার সফটওয়্যার কেনা শুরু করে। ওই বছরই আমরা প্রথম ই-গভর্ন্যান্স সফটওয়্যারের কাজ পাই। বর্তমানে টেকনোভিসতার ৯৮ শতাংশ কাজই ই-গভর্ন্যান্সের। সরকারের বিভিন্ন বিভাগে আমরা সফটওয়্যার সেবা দিয়ে থাকি। এই সফটওয়্যারগুলো সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করে। যেমন সারাদেশে প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া হয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে; এটি আমাদের সফটওয়্যারের মাধ্যমে দেয়া হয়। পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রথমবারের মতো ট্যাবের মাধ্যমে সারাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর একটি বড় ধরনের জরিপের কাজ করছে, যা রিয়েল টাইমে হালনাগাদ ও বিশ্লেষণ হচ্ছে; এই সফটওয়্যারটিও আমরা তৈরি করেছি।

মংলা বন্দরের সব অপারেশন আমাদের সফটওয়্যারের মাধ্যমে চলে।

বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় বিলিং ব্যবস্থাপনা ‘রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন বোর্ড’ বা আরইবি, সারা দেশে যাদের লক্ষ লক্ষ গ্রাহক আছে। আমরা আরইবির জন্য একটি ইন্টিগ্রেটেড বিলিং সিস্টেম তৈরি করেছি, যেটা এখন ইমপ্লিমেন্ট হচ্ছে। মংলা বন্দরের সব অপারেশন আমাদের সফটওয়্যারের মাধ্যমে চলে। চট্টগ্রাম বন্দর, যেখানে বিদেশি সফটওয়্যার দিয়ে কাজ করছে, সেখানে মংলা বন্দর কাজ করছে বাংলাদেশের তৈরি সফটওয়্যার দিয়ে।

এ ধরনের অনেক সফল সফটওয়্যার টেকনোভিসতা থেকে চলছে। আমাদের ৯৫ শতাংশেরও বেশি আর্থিক শক্তির উৎস ই-গভর্ন্যান্স। সরকারের যতগুলো বিভাগ বা দপ্তর আছে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশের সঙ্গে আমরা কাজ করেছি, বা করছি। বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমাদের একটি বড় প্রকল্প সফলভাবে ইমপ্লিমেন্ট হয়েছে। বেসরকারি খাতেও আমাদের কিছু গ্রাহক আছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য টেকনোভিসতা কোনো আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে না। আমরা শুধু স্থানীয় বাজারেই ফোকাস করি। টেকনোভিসতার ৫৫–র বেশি কর্মীর মাধ্যমে মাসে এক থেকে দেড় কোটি টাকা রাজস্ব আসে। এদের মধ্যে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টেই কাজ করছেন ৪৫ জনের বেশি কর্মী।

আমি বলব, বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে এসে অনেকটা অসুবিধাই হয়েছে।

টেকভিশন২৪: বিদেশে লেখাপড়া শেষে বাংলাদেশে এসে ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে বা যুক্ত হতে আপনি কী কী সুবিধা পেয়েছেন এবং কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন?
নাভিদুল হক: আমি বলব, বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে এসে অনেকটা অসুবিধাই হয়েছে। কারণ যতই ভাবি না কেন, আমরা অনেক এগিয়ে গেছি কিন্তু বিদেশি যে আইডিয়া বা ধ্যান-ধারণা, সেগুলোর বেশিরভাগই বাংলাদেশে চলে না—এটাই বাস্তবতা। বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে এসে বাংলাদেশে মানিয়ে চলার চ্যালেঞ্জ আছে। গত ১৫ বছরে আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি, শিখিয়ে নিয়েছি, বুঝিয়ে নিয়েছি। এখন সেভাবেই চলছে। ১৫ বছর আগে বিদেশ থেকে শিখে এসে যেগুলো বাস্তবায়ন করতে চেয়েছি, সেগুলো আসলে করতে পারি নি। কেউ যদি বলে বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে এসে সফলভাবে বাংলাদেশে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তার ম্যাজিকের গল্প শুনতে চাই।

আর চ্যালেঞ্জের কথা যদি বলি, আসলে একেক ব্যবসার একেকরকম চ্যালেঞ্জ। এখন একটা ব্যবসা যদি ভালো চলে তাহলে একজন ব্যবসায়ী কেন সেটা খারাপ বলবে। একজন ব্যবসায়ী যখন তার ব্যবসা প্রসঙ্গে কথা বলেন, তিনি সত্যিটাই বলেন—আমি এমনটাই মনে করি। একটার পর একটা ঝামেলা তো আমাদের নিতেই হচ্ছে। করোনা অতিমারি গেল, এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি…। সবমিলিয়ে ব্যবসার চ্যালেঞ্জ তো একের পর এক চলছেই।

টেকভিশন২৪: ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার সাফল্যের পেছনে নিজের চেষ্টা, মেধা, পরিশ্রম তো আছেই, এর পাশাপাশি কাদের সহযোগিতা বা অনুপ্রেরণা বেশি পেয়েছেন?
নাভিদুল হক
: সফলতার ব্যাখ্যা আমার কাছে অনেক বড়। আমার মনে হয় না আমি সেটার কাছাকাছি এখনও যেতে পেরেছি। মাইক্রোসফট, ডেল, ইনটেল বা ফেসবুক আমার জন্য নয়। সফলতার ব্যাখ্যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। এখন তো সফল বলতে বোঝায়—আমার ব্যবসাটা ভালো চলে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমরা অনেকেই সেটাও বলতে পারছিনা যে, আমাদের ব্যবসাটা ভালো চলছে। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

সফলতার ব্যাখ্যা আমার কাছে অনেক বড়। আমার মনে হয় না আমি সেটার কাছাকাছি এখনও যেতে পেরেছি।

আমার প্রধান অনুপ্রেরণা আমার বাবা-মা। আমি দেখেছি, তাঁদের ভেতর সততা আছে। এই সততা নিজের পাশাপাশি অন্যের সঙ্গেও। আরেকজনকে ঠকিয়ে বা মেরে খাব—এই জিনিসটা তাদের ভেতর দেখিনি। এটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।

আর ব্যক্তিজীবনে দুটি আদর্শ আমি মেনে চলি। প্রথমটা হলো—সবার জীবনেই টাকার প্রয়োজন, তবে টাকাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ভালো কিছু করা। সেই ভালো কিছু করা যেমন হতে পারে আমার যারা কর্মী আছে তাদের ধরে রাখা, তাদের বেতন নিশ্চিত করা, তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখে রাখা, সমাজকে কিছু সহযোগিতা করার চেষ্টা করা। আমি টাকার প্রতি লোভী নই এবং চেষ্টা করি প্রতিদিন ভালোর সঙ্গে থাকার। জেনেশুনে যেন কাউকে ব্যথা না দিই, দুঃখ না দিই বা কারো ক্ষতি না করি।

সবার জীবনেই টাকার প্রয়োজন, তবে টাকাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়।

দ্বিতীয়টা হলো—সাধারণ জীবনযাপন করা, সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, হাসিমুখে কথা বলা। আসলে আমি যে অনুপ্রেরণা বা শিক্ষা পেয়েছি, সেগুলো খুব সাধারণ, এমন বড় বা কঠিন কিছু না।

টেকভিশন২৪: মোহাম্মদী গ্রুপের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন। আপনাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ও কর্মীর সংখ্যা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে…
নাভিদুল হক: বর্তমানে পরিকল্পনা হচ্ছে, ব্যবসাগুলো ঠিকঠাক ধরে রাখা। যেহেতু প্রধানত আমাদের তৈরি পোশাকের ব্যবসা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তৈরি পোশাকের অর্ডার কমে গেছে। আর প্রযুক্তিখাতের ব্যবসা নিয়ে সরকার নিজেই নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে, যুদ্ধ–পরিস্থিতির কারণে। সরকারি কাজের বাজেট, খরচ—এ সবও চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। ফলে প্রযুক্তিখাতের ব্যবসার ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। তবে আশা করি, দ্রুত এই অবস্থার পরিবর্তন হবে।

আমাদের গ্রুপের মোট কর্মী ১০ হাজারের কাছাকাছি। তৈরি পোশাক কারখানা, তথ্যপ্রযুক্তি, গৃহনির্মাণ, গণমাধ্যম এবং পাওয়ার জেনারেশন—এই পাঁচটি প্রধান ব্যবসা আমাদের। আমরা কোনো ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার না বা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত নই। বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংক হচ্ছে, এ খাতে আমাদের বিনিয়োগ করার ইচ্ছে ও আগ্রহ আছে। তবে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। কথাবার্তা চলছে।

টেকভিশন২৪: আপনার স্টার্টআপ ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাই। এছাড়া, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগ–ব্যবস্থা কতটা উদ্যোক্তাবান্ধব বলে মনে করেন? আমাদের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগকারীদের কতটুকু আকৃষ্ট করতে সক্ষম হচ্ছে?
নাভিদুল হক: আমার একটা স্টার্টআপ ব্যবসা আছে—‘বঙ্গ’। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা মোহাম্মদী গ্রুপের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে ২০১৩-১৪ সালে অর্থাৎ আমার ক্যারিয়ার শুরুর ৫-৭ বছর পর আমি অনুভব করলাম আমার নিজের থেকে কিছু করা উচিত। কারণ আমি বাবা-মায়ের ব্যবসা দেখভাল করি, সেটা তো আমার নিজের ব্যবসা না। বাবা যেটা দিয়ে গেছেন, সেটাই আমি এগিয়ে নিচ্ছি, চালাচ্ছি বা ধরে রাখছি। আমার ইচ্ছে ছিল, নিজের উদ্যোগে পারিবারিক আবহের বাইরে গিয়ে নিজের একটা ব্যবসা গড়ে তোলা। ২০০১ সালের দিকে দেশে প্রথম প্রযুক্তির সহায়তায় অর্থাৎ ভিডিও সম্পাদনার সফটওয়্যার দিয়ে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির সিস্টেমগুলো আসা শুরু করে। স্কুলজীবনের সেই সময়েই আমার এক বন্ধু ও আমি এসব সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভিডিওগ্রাফি ও সম্পাদনার মাধ্যমে ডিজিটাল টেকনোলজি দিয়ে কীভাবে কন্টেন্ট তৈরি করা যায়, সেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করি। এরপর যে সময় ‘বঙ্গ’ শুরুর পরিকল্পনা করি, তখন আমার সেই বন্ধু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম মেকিং বা ডিজিটাল ফিল্ম মেকিং বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে এসেছে। তখন আমরা নিজেরা একটা ব্যবসা শুরুর সিদ্ধান্ত নিই।

আমি আমার বাবার কাছ থেকে আড়াই কোটি টাকা ঋণ নিই। আমার বন্ধু আড়াই কোটি টাকা ঋণ নিয়ে মোট পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে আমরা কোম্পানিটি তৈরি করি, যা ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত। এটি একটি ডিজিটাল ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম।

সম্প্রতি আমরা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিনিয়োগ পেয়েছি। আমাদের কোম্পানি প্রায় ছয়শ কোটি টাকা ভ্যালুয়েশনে বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। দেশে ‘বঙ্গ’ প্ল্যাটফর্মটির বাৎসরিক আয় দেড়শ’ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ মাসে ১৫-২০ কোটি টাকা আয় হয় এখান থেকে। যেহেতু স্টার্টআপটা একদম স্ক্র্যাচ থেকে শুরু করেছি এবং এটা আজকে একটা বড় কোম্পানি, প্রায় একশ’র বেশি কর্মী আছে, বিশ্বের কয়েকটা দেশে আমাদের নিজস্ব অফিস আছে; ফলে মোটামুটি সফল বলতে পারেন।

দেশে আরও কয়েকটি সফল স্টার্টআপ আছে। এটি একটি নতুন খাত, যা গেল ৫-৭ বছর ধরে গড়ে উঠছে। এবং আমি নিজেকে এই কারণে সৌভাগ্যবান মনে করি যে, আমি এই খাতের একজন অংশীদার। আমি বলব, এগুলো প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নতুন ব্যবসা। আবার টেকনোভিসতার কথা যদি বলেন, সেটা একধরনের পরিপূর্ণ প্রযুক্তির ব্যবসা। একেক ব্যবসা একেক ধরনের।

চালডাল, শপআপ, পাঠাও—এরকম বড় বড় স্টার্টআপ কোম্পানি বাংলাদেশে তৈরি হয়ে গেছে। সবাই একটি কথাই বলে যে, তাদের বিনিয়োগ নিয়ে আসাই চ্যালেঞ্জ। আমি বলব, এই চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের সবার জন্যই। কারণ এটি এক ধরনের ইমেজ সংকট যে, এখনও অনেক দেশের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে না। বাংলাদেশ যে আগামীর একটি পাওয়ার হাউজ, সেটা অনেকেই উপলব্ধি করে না বা মুখে বললেও মন থেকে বিশ্বাস করে না। কিন্তু আমি তো দেখি সফল স্টার্টআপদের কর্মীসংখ্যা অনেক বা তারা চুক্তিভিত্তিক হলেও অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। অবশ্যই তাদের বিশাল অংশীদারীত্ব আছে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে।

১০ হাজারের বেশি জনবলের কোম্পানি দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদী গ্রুপ 

টেকভিশন২৪: ‘বঙ্গ’কে ব্যবসায়িকভাবে নেটফ্লিক্সসহ দেশি–বিদেশি প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার এবং প্রতিযোগিতার বাজারে অল্প সময়ে আপনারা কীভাবে বঙ্গকে সফল ও শক্তিশালী একটা অবস্থানে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন?
নাভিদুল হক: ২০১৪ সালে আমরা যখন ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসায় আসি তখন বাংলাদেশে এই বিষয়টি সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষই জানতো না। আমরা একদম প্রথম দিককার প্রতিষ্ঠান, যারা এখনো টিকে আছি। সেসময় আরো কয়েকটি কোম্পানি শুরু করেছিল, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা ব্যবসায় টিকে থাকতে পারেনি। আমাদের পরেও অনেক প্রতিষ্ঠান এসেছে, তারা ব্যবসা করছে। বাংলাদেশে কিন্তু দেশি প্রতিষ্ঠানের বাইরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যবসা করছে, প্রচুর মানুষ নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, হইচই, জি-ফাইভ দেখে। দেশিয় ‘চরকি’ও অনেক দর্শক দেখেন। আমি তো মনে করি তারা ভালো কন্টেন্ট বানাচ্ছে। ফলে আজকের দুনিয়ায় একজন কী দেখবে, কীভাবে দেখবে তার জন্য অনেক সুযোগ আছে। সেখানে আমরাও ব্যবসা করছি, টিকে আছি। কিন্তু এ খাতে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করতে হয় একটি ভালো কন্টেন্ট বানানোর জন্য। ফলে আমাদেরকে বিদেশি বিনিয়োগ এনেই ব্যবসাটা করতে হচ্ছে এখন।

আমরা শুরুর দিকে যে উদ্যোগগুলো হাতে নিয়েছিলাম, তার মধ্যে অন্যতম হলো, কন্টেন্টগুলোকে ডিজিটাল করা। ২০১৪-১৫ সালে আমরা যখন শুরু করেছি তখন মানুষ ডিজিটাল বলতে বুঝত ডিভিডি বা ডিজিটাল ভিডিও ডিস্ক। ফোনের মধ্যে স্ট্রিমিং করে কন্টেন্ট দেখবে—সেটা অনেকেই বুঝে উঠতে পারে নি। তখনই আমরা অনেক কন্টেন্ট মার্কেট থেকে কিনে নিই ডিজিটাল স্ট্রিমিংয়ের জন্য। প্রথমে আমরা আমেরিকা থেকে প্রযুক্তি নিয়ে এসেছিলাম। সেটা বাংলাদেশে কাজ করেনি। কারণ দেশে তখন ইন্টারনেটের যে গতি ও অবকাঠামো ছিল, সেটি আমেরিকার সেই প্রযুক্তিটি চলার উপযোগী ছিল না। তাই আমরা নিজস্ব উদ্যোগে নিজেদের প্রযুক্তি তৈরি করে নিয়েছি। আজ আমরা যত কন্টেন্ট দেখাচ্ছি, সেগুলোর পেছনে যত প্রযুক্তি আছে, সব আমাদের নিজেদের উদ্যোগে তৈরি এবং আমাদের কারিগরি যে দল আছে, তারাই সেগুলো পরিচালনা করছে। অনেক ক্ষেত্রেই অন্য প্ল্যাটফর্মগুলো যদি দেখেন, যেমন ‘চরকি’, তারা কিন্তু তৃতীয় কোনো পক্ষের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে ‘বঙ্গ’ কিছুটা আলাদা।

টেকভিশন২৪: আপনার আরেকটি সফল প্রতিষ্ঠান রয়েছে ‘ফিফটি–টু ডিজিটাল’। এর মাধ্যমে দেশে-বিদেশে কী ধরনের ডিজিটাল সলিউশন দিচ্ছেন আপনারা? এ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ব্যবসায়িক সফলতা বা রেভিনিউ কেমন?
নাভিদুল হক: ‘ফিফটি-টু ডিজিটাল’ বাংলাদেশে একটি ড্যানিশ জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি। আমরা ড্যানিশ বাজার অর্থাৎ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বাজারের জন্য কাজ করি। মূলত ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড এসব দেশের জন্য। আমাদের পার্টনার যে প্রতিষ্ঠান, তারা ডেনমার্কে নিবন্ধিত কোম্পানি। তারা তাদের গ্রাহকদের জন্য কাজগুলো বাংলাদেশের ডেভেলপারদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। এখানেও প্রায় ৩০ জনের বেশি সফটওয়্যার ডেভেলপার আছে। এই প্রতিষ্ঠানের মাসিক আয় এক থেকে দেড় কোটি টাকার বেশি। আমরা দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের কাজ করে যাচ্ছি। যেহেতু এটি শতভাগ আউটসোর্সিং ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, এখানে আমাদের সব কাজের জন্য বৈদেশিক মুদ্রাতেই লেনদেন হয়।

টেকভিশন২৪: আপনি কোন কোন ব্যবসায়িক সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং বর্তমানে কোনগুলোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন? আপনার এবং আপনাদের প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি বা পুরস্কার সম্পর্কে জানতে চাই।
নাভিদুল হক: যেহেতু আমার বাবা বিভিন্ন ধরনের অ্যাসোসিয়েশন বা বাণিজ্যিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেই সূত্রে কিছু সংগঠনে আমারও কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আমাকে ভবিষ্যতে সব বাণিজ্যিক সংগঠনের সভাপতি বা কর্ণধার হতে হবে—এরকমটা মনে করি না। একটা বাণিজ্যিক সংগঠন কীভাবে কাজ করে সেটা দেখা ও বোঝার জন্য এসব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমি সফটওয়্যার ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘বেসিসে’র পরিচালক এবং দেশের বেসরকারি পাওয়ার প্ল্যান্ট মালিকদের সংগঠন ‘বিপা’র সহ-সভপতি ছিলাম। বর্তমানে তৈরি–পোশাক মালিকদের সংগঠন ‘বিজিএমইএ’ এবং বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন ‘অ্যাটকো’র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। একটি নতুন সংগঠন হতে যাচ্ছে ‘ওটিটি গিল্ড অব বাংলাদেশ’ নামে, সেখানে আমি আহ্বায়ক।

আর, আমি মনে করি, পুরস্কার এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়। বেসিসের অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছি, ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। তবে পুরস্কার নিয়ে আমি এত চিন্তিত নই। তাই হিসেবও রাখি না। সত্যি বলতে, পুরস্কারের জন্য নয়, আমি মূলত কাজ করি আত্মতৃপ্তির জন্য।

তাঁর অভাব অনুভব করেন বলেই সবাই এখনো তাঁর কথা মনে করেন।

টেকভিশন২৪: লক্ষ লক্ষ বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানে মোহাম্মদী গ্রুপের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলুন।নাভিদুল হক: আমাদের যে ব্যবসাগুলো আছে, সেখানেই তো আমরা তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছি। আমার বাবা আনিসুল হক তো হঠাৎ করে মেয়র হয়েছিলেন। তিনি রাজনৈতিক লোক ছিলেন না। মেয়র হওয়ার পর তিনি দুই বছরে কী কী কাজ করেছেন, কী চমক দেখিয়েছেন, সেটা সবাই দেখেছেন। তাঁর অভাব অনুভব করেন বলেই সবাই এখনো তাঁর কথা মনে করেন। তাঁর ভেতর কাজ করার একটি দৃঢ় ইচ্ছে ছিল। শহরের জন্য উনি যে কাজ করেছেন, সেগুলো স্মৃতি হিসেবে আমাদের ধরে রাখতে পারা কঠিন। কারণ আমরা তো আর উত্তর সিটি করপোরেশন বা মেয়র অফিসের কোনো অংশ  নই। ওনার স্মৃতি হচ্ছে ওনার কর্মক্ষেত্রের স্মৃতি, ওনার পারিবারিক স্মৃতি। সেগুলো আমরা ধরে রেখেছি আমাদের কাজের মাধ্যমে। উনি সবসময় চাইতেন যেন আমরা ভালোমতো কাজ করি, স্থিতিশীলভাবে চলি, ব্যবসা ভালো করি, মানুষকে সহযোগিতা করি। সেগুলো আমরা করছি। আমাদের অনেকগুলো ফাউন্ডেশন আছে, ইনস্টিটিউিশন আছে, যেগুলোর মাধ্যমে আমরা মানুষকে সাহায্য করি।

টেকভিশন২৪: আপনাদের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পাশাপাশি ভবিষ্যতে বিশ্বজুড়ে প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়ে কি কোনো পরিকল্পনা করছেন?
নাভিদুল হক: বিশ্বে কোনো প্রভাব আনবে, আমার মনে হয় না আমরা এখনো সেভাবে তৈরি হয়েছি। বাংলাদেশ কিন্তু এখনো বিলিয়ন ডলারের আউটসোর্সিংয়ের দিকে যেতে পারেনি। তবুও ধরে নিলাম ফ্রিল্যান্সিংসহ কিছু খাত মিলে বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে আইটিতে। অন্যদিকে দেশে মাত্র চার থেকে পাঁচটি তৈরি–পোশাক কারখানাই বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট করছে। সুতরাং আইটি খাতে বৈশ্বিক স্কেলে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। আরেকটি বিষয়, আমরা কি বৈশ্বিক উদ্ভাবনের জায়গায় কোনো কাজ করতে পারছি? আমাদের তৈরি করা কোনো প্রযুক্তি কি বিশ্বব্যাপী ব্যবহার হচ্ছে? কোনো প্রতিষ্ঠান হতে হবে না, একটি সেবা হোক বা একটি উদ্ভাবন—যেকোনো কিছুই, আমরা কিন্তু এখনো সেই বৈশ্বিক স্কেলে যেতে পারিনি, এটাই বাস্তবতা। ফেসবুক অ্যাক্টিভিটির দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষ পর্যায়ে, এটি আমরা জানি। কিন্তু ফেসবুকের একটি অফিস কি বাংলাদেশে আছে? ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বৈশ্বিক অনেক প্রতিষ্ঠানের মনোযোগ বাংলাদেশের দিকে নিয়ে আসতে পারিনি। একসময় স্যামসাং বাংলাদেশে তাদের গবেষণা ও উন্নয়নবিষয়ক কার্যালয় করেছিল, সেটার আজ কী অবস্থা? সেখানকার বেশিরভাগ কর্মীরই আজ চাকরি নেই, তারা সেই কার্যক্রম ছোট করে ফেলেছে বা বন্ধ করে দিয়েছে। তাহলে আমাদের কৌশলগত ভুলটা কোথায়, যে কারণে আমরা এখনো বিদেশি কোম্পানিরগুলোকে আকৃষ্ট করতে পারছিনা বা নিজেদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে পারছি না? স্থানীয় বাজারের জন্য নিজেদের পণ্য তৈরি করতে অন্যদের দেখাদেখি হয়তো কারখানা করেছে অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান কিন্তু আমি উদ্ভাবনের জায়গা নিয়ে কথা বলছি, সেটা তো বাংলাদেশে হচ্ছে না। তাই এটুকু বুঝতে পারি, বৈশ্বিক যে অবস্থান নিয়ে আমরা কথা বলি, সেটা থেকে এখনও আমাদের অবস্থান অনেক দূরে।

আমরা ‘জাদু ডিজিটাল’ করেছিলাম ডিজিটাল কেবল্‌ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। বিশ্বের অনেক বাজারে সংশ্লিষ্ট সরকার ডিজিটাল কেবল্‌ ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বক্স ছাড়া কোনো টিভি দেখা যায় না। আমরাও আশা করেছিলাম বাংলাদেশ সরকার এটা বাধ্যতামূলক করবে। ২০১৪-১৫ সালে এটা বাধ্যতামূলক করার জন্য কাজও হয়েছিল। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এটা নিয়ে অনেক প্রচেষ্টাও ছিল। এমনকি করোনার পরেও, ২০২১ সালেও সরকার এটা নিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু বাধ্যতামূলক করতে পারেনি বলে এই ব্যবসাটিও বেড়ে ওঠেনি। ফলে সেসময়ের কোনো কোম্পানিই বড় হতে পারেনি। এখন প্রযুক্তি পরিবর্তন হয়ে গেছে, কোনো ডিজিটাল বক্স লাগছে না। এখন টিভিতে অ্যাপস দিয়েই দেখা যাচ্ছে। ফলে এই ব্যবসায় আমরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলাম। তবে আমরা এই ব্যবসাটিকে আরেকটি নতুন দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছি।

আর, তৈরি–পোশাক খাতকে প্রযুক্তি খাতে টেকওভার করা থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে আছি। দেশের প্রযুক্তি খাতে কমপক্ষে এক হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে—এরকম কয়টি প্রতিষ্ঠান আছে? হ্যাঁ, কলসেন্টার প্রতিষ্ঠান এরকম কর্মসংস্থান করতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না এরকম প্রতিষ্ঠান ১০-২০-৫০টা থাকবে, যেখানে এক থেকে পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে, তার আগে তো আমাদের কথাই বলা উচিত না। যেখানে তৈরি–পোশাক খাতের মতো কর্মসংস্থানই আমরা সৃষ্টি করতে পারছি না বা এমন কিছুই নেই যেখানে হাজার হাজার ডেভেলপার কাজ করছে আন্তর্জাতিক বাজারে, সেখানে আমাদের তৈরি–পোশাক খাতের সঙ্গে এ ধরনের তুলনাই করা উচিত না।

ছেলের সাথে নাভিদুল হক।

টেকভিশন২৪: আপনার দৃষ্টিতে একজন সফল ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে কার কথা বলবেন? যাকে আপনি আদর্শ মানেন।
নাভিদুল হক: বাংলাদেশে সফল ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব অনেকেই আছেন, যাঁদের নাম আমরা সবাই জানি। একেকজনের একেকটা গুণ আমার ভালো লাগে। যেমন প্রাণ গ্রুপের সানি ভাই, ওনাকে আমি খুবই পছন্দ করি। অত্যন্ত পরিশ্রমী মানুষ। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের সবকিছুকে ত্যাগ করে ব্যবসাকে বড় করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ। সাধারণ জীবনযাপন করে ব্যবসার প্রতি তিনি মনোযোগী থাকেন। তিনি আমার এক ধরনের অনুপ্রেরণা। এছাড়া আমার অনুপ্রেরণায় আছেন নাসিম মনজুর। তিনি চামড়াশিল্পে খুব ভালো ব্যবসা করছেন। ব্যবসাটা ওনার বাবার ছিল, সেটিকে তিনি অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন। বাবার ছোট্ট ব্যবসায় ছেলে যুক্ত হয়ে সে ব্যবসাকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার এক অনন্য উদাহরণ তিনি। এরকম আসলে অনেকেই আছেন, বলে শেষ করা যাবে না। তবে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা অবশ্যই আমার বাবা-মা, যাঁরা একদম প্রায় শূন্য থেকে সবকিছু শুরু করে ব্যবসায় সাফল্যের পথ তৈরি করেছেন।

টেকভিশন২৪: আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি বাজারের ব্যবসা ধরতে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা কেমন বলে মনে করেন?
নাভিদুল হক: আমাদের প্রযুক্তিভিত্তিক সংগঠনে যে সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, আমি বলব তারা ভালো। খেয়াল করেছি, যারাই এসব সংগঠনের নেতৃত্বে থাকেন, তারা সদস্যদের জন্য সবসময় খোলামেলা থাকেন। তবে সংগঠন, দেশ সবকিছু মিলিয়ে আমাদের এখনো অনেক উন্নতির জায়গা আছে। সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে সংযোগের জায়গায়, পারস্পরিক সহযোগিতার জায়গায় ভালো করছে। কিন্তু বেসিস তো আর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দিবে না, নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে।

টেকভিশন২৪: এআই, রোবটিক্স প্রযুক্তির উত্তরোত্তর আধুনিকায়নের বিশ্বে চাকরির বাজারের প্রস্তুতিতে ভারত, চায়না ও ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় আমাদের লাখো তরুণ-তরুণীরা কতটুকু এগিয়ে আছে বলে মনে করেন?
নাভিদুল হক: আমি মনে করি, আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। আমরা একজন ভালো ডেভেলপার হায়ার করতে পারি না বাংলাদেশে—এটাই বাস্তবতা। আমাদের যারা ডেভেলপার হায়ার করতে যাই, তারা পরীক্ষায় পাশই করতে পারে না। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত দক্ষতা, শিক্ষাগত দক্ষতায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই সবকিছু ঠিক করে আনতে হবে।

বেশি বড় স্বপ্ন না দেখে, স্বপ্নগুলোকে একটু বাস্তবসম্মত করতে হবে এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।

টেকভিশন২৪: একজন সফল তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে আমাদের দেশের শত শত তরুণ চাকরিপ্রার্থী ও উদ্যোক্তার জন্য আপনার পরামর্শ কী?
নাভিদুল হক: প্রথমত, যারা নতুন উদ্যোক্তা আছেন, বেশি বড় স্বপ্ন না দেখে, স্বপ্নগুলোকে একটু বাস্তবসম্মত করতে হবে এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। এখন যারা শিক্ষার্থী, তাদের কিছু দক্ষতা উন্নয়ন করতে বলব। শুধু লেখাপড়া করলে হবে না, কোনো একটি নির্দিষ্ট দক্ষতা থাকতে হবে। সেটা প্রযুক্তিগত দক্ষতা হলে সবচেয়ে ভালো।

টেকভিশন২৪: আপনার শখ ও প্রিয় মানুষদের নিয়ে কিছু বলুন…
নাভিদুল হক: আসলে বয়স যত বাড়ছে, শখ–আহ্লাদ তত কমে আসছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জীবন আসলে কঠিন হচ্ছে। আমার বাবা-মা আমাকে বড় করেছেন একজন ভালো মানুষ হিসেবে, আমি এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আমারও ছোট সন্তান আছে। এখন আমার একটাই ইচ্ছে, আমার বাচ্চাদেরও যেন আমি ভালো মানুষ হিসেবে বড় করতে পারি এবং ওরাও যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। আমি সপ্তাহে ছয়দিন অফিস করি এবং প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করি। ফলে এর বাইরে গিয়ে অন্য কাজ করার সুযোগ আসলে খুব একটা হয় না। খেলাধুলা বলতে পার্কে একটু হাঁটতে যাই, ব্যায়াম করি। গান শুনি হয়তো বা মাঝে মাঝে। আসলে সময় কুলিয়ে উঠতে পারি না।

টেকভিশন২৪: আপনাকে ধন্যবাদ।
নাভিদুল হক: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন