বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকারকে এ খাতে কর-অব্যাহতি ২০৩০ পর্যন্ত বিবেচনার অনুরোধ

৪র্থ শিল্প বিপ্লবকে আলিঙ্গন করতে তথ্যপ্রযুক্তি উদোক্তা সৃষ্টি ও বিদেশে বাংলাদেশীদের কর্মসংস্থান করা এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ‘দি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচার’ (বিএনডিএ) প্ল্যাটফর্ম-এর মাধ্যমে সরকারি অফিসগুলোর মধ্যে ইন্টার-অপারেবিলিটির কথা এবারের বাজেট-বক্তৃতায় থাকায় আমি অনেকটাই উৎসাহিত বোধ করছি।  ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে Cloud Service, System Integration, e-learning platform, e-book publications, Mobile Application development service-সহ ২২টি আইটি এনাবেল্ড সার্ভিসেস (ITES)-এর উপর ২০২৪ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতির সুবিধা বলবত রাখাও প্রশংসনীয়। দেশে উৎপাদিত হার্ডওয়্যার ডিভাইসকেও কর অব্যাহতির আওতায় আনার প্রয়োজন বলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী মত প্রকাশ করেছেন বলে তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

স্থানীয় কম্পিউটার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বার্থরক্ষায় কম্পিউটার দ্রব্যাদি আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রদান ও স্থানীয়ভাবে সেলুলার ফোন উৎপাদন উৎসাহিত করতে ফিচার ফোন আমদানির উপর শুল্কহার বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। এতে দেশে ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনে বিনিয়োগকারীরা আরও বেশী উৎসাহিত হবেন। ফিচার ফোনের বদলে স্মার্টফোন ব্যবহার বাড়বে বলেও আশা রাখি।

আইসিটি খাতে এবার ১৭২০ কোটি টাকার বিশাল বাজেট বরাদ্দ পেয়ে যারপরনাই খুশী হয়েছিলাম শুরুতে। গতবছরের ঘোষিত বাজেটের থেকে প্রায় ২০% বেশী এই বরাদ্দ! কিন্তু এই টাকা কোথায় কিভাবে খরচ করা হবে, তা’র দিকনির্দেশনা যখন কোথাও খুঁজে পেলাম না, তখন মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। সরকারী মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর ইত্যাদির ডিজিটালাইজেশনে স্থানীয় কোম্পানীগুলো কি করে সম্পৃক্ত হতে পারে, তা’র একটা সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকাটা বাঞ্ছনীয়।

সফটওয়্যার ও ITES ব্যবসায়ে ২০২৪ পর্যন্ত কর্পোরেট ট্যাক্স অব্যাহতি থাকলেও গত প্রায় দেড় বছরে এ ব্যবসায় প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সামনে রপ্তানী বৃদ্ধিসহ যে লক্ষ্যগুলো আছে, সেগুলোকে বাস্তবায়ন করতে হলে, এই খাতে বেশ কিছু স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীরা যাতে আকৃষ্ট হতে পারেন, তাই এ খাতে কর-অব্যাহতির সময়সীমা ২০৩০ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাবনা করেছিলাম বাজেটের আগে। এই ঘোষণাটি যত তাড়াতাড়ি আসবে, বিনিয়োগকারীরা তত তাড়াতাড়ি বিনিয়োগ করবেন বলে মনে করি। বিষয়টা অতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

ইন্টারনেট এখন সব ধরণের ব্যবসায়ের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল। এই ইন্টারনেটের উপর ভর করেই সব রকমের ডিজিটাল কার্যক্রম চলছে। তাই এই ইন্টারনেটকে সহজলভ্য ও সুলভ করতে এর উপরে থাকা ভ্যাট প্রত্যাহার ও ইন্টারনেট সার্ভিসকে ITES হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই প্রয়োজন। ইন্টারনেট সার্ভিস থেকে যতটুকু কর সরকার পায়, তা’ থেকে অনেক বেশী রাজস্ব সরকার পেতে পারে যদি ইন্টারনেট-নির্ভর ব্যবসায়গুলো প্রসার লাভ করে। ব্রডব্যাণ্ড ইন্টারনেট যদি সুলভে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা’হলে সেখানকার তরুণ জনগোষ্ঠি এই ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজস্ব উদ্যোগ শুরু করতে পারবে এবং দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। ইন্টারনেটের উপর ভর করে ডিজিটাল কমার্স, ডিজিটাল পেমেন্ট, টেলিমেডিসিন, ভিডিও-স্ট্রিমিং সহ অন্যান্য OTT সার্ভিস প্রভৃতি নতুন নতুন ব্যবসায় শুরু হবে দেশে। যথাকালে সরকার সেই সব ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড থেকে অনেক বেশী রাজস্ব আহরণ করতে পারবে। তাই, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ প্রধান উপাদান ইন্টারনেট সার্ভিসে কর ছাড় দিলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশী আইটি কোম্পানীগুলোর এখন বড় বড় প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করার অভিজ্ঞতা তৈরী হয়েছে। এই স্থানীয় কোম্পানীগুলোই ড্রাইভিং লাইসেন্স, NID, গাড়ীর রেজিস্ট্রেশন-প্লেট, হজ্জ ম্যানেজমেন্ট, ডাটা-সেন্টার ইত্যাদি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সাফল্য দেখিয়েছে। অন্যান্য অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনায়াসেই এই কাজগুলোর পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব। বাংলাদেশ সরকার ও সেই দেশের সরকারের মধ্যে এ ব্যাপারে যদি পারস্পরিক চুক্তি হয় যে, বাংলাদেশ সেই দেশকে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়ন করবে এই শর্তে যে, কাজগুলো বাংলাদেশী কোম্পানীকে দিয়েই করাতে হবে, তা’হলে আমাদের স্থানীয় কোম্পানীগুলোর বিদেশে কাজ করা অভিজ্ঞতা তৈরী হবে; একইসাথে দেশের টাকা দেশেই ফেরৎ আসবে। এর ফলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিরও পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমাদের দেশকে সবাই দক্ষ জনগোষ্ঠির দেশ হিসেবে চিনতে শুরু করবে।

এই টেকনিকাল অ্যাসিস্টেন্স (TA) প্রজেক্টের জন্য ৫০০ কোটি টাকার একটি বরাদ্দ রাখার কথা প্রস্তাব করেছিলাম বাজেটে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন উল্লেখ দেখিনি বাজেটে। ব্যাপারটা বিবেচনা করার অনুরোধ জানাচ্ছি অর্থ মন্ত্রণালয়েকে।

আইসিটি খাতে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর লক্ষ্যে ৩০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ বরাদ্দ রাখারও অনুরোধ করেছিলাম বাজেট-পূর্ববর্তী আলোচনাগুলোতে। এই টাকা থেকে নারী-উদ্যোক্তাদের জন্য ২% সুদের হারে সহজ-শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারলে এই খাতে নারীদের অংশগ্রহণ অনেকটাই বাড়ানো যেত।

মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের মুনাফার উপর কর বাড়ানোর প্রস্তাবটা একটু বিভ্রান্তিকর। যখন সরকার ক্যাশলেস সোসাইটির কথা বলছেন, যখন আমরা সকল প্রকার ডিজিটাল লেনদেনের উপর থেকে মূসক অব্যাহতি দেওয়ার কথা প্রস্তাব করছি, তখন এধরণের কর বৃদ্ধির প্রস্তাব হতাশার সৃষ্টি করে। অর্থ মন্ত্রণালয় বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করবেন বলে আশা করি।

দেশে বর্তমানে মেট্রোরেল, রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার-প্লান্ট, নতুন এয়ারপোর্ট টার্মিনাল-এর মতো প্রচুর পরিমাণে বড় বড় অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নেও বাজেট বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখি যে, হার্ডওয়ার বা যন্ত্রপাতি কেনার জন্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ থাকলেও সফটওয়্যার বা আইটি পরিষেবার জন্য তেমন কোনো বাজেট বরাদ্দ থাকে না বললেই চলে। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি তাতে যদি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা না যায় এবং স্থানীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো যদি এসব অবকাঠামোর সফটওয়্যার বা আইটি পরিষেবা প্রদানের সুযোগ না পায় তাহলে প্রকৃত অর্থে এদেশের সফটওয়্যার ও আইটি পরিষেবা শিল্প যেমন সম্প্রসারিত হবে না, তেমনি বিপুল জনগোষ্ঠির সম্পৃক্ততা ও কর্মসংস্থানের সুযোগও বিনষ্ট হবে।

প্রায় ২৫টি বিষয়ে ট্রেনিং-এর উপর আগামী দশ বছরের কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বাজেটে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, এর মধ্যে আইটি ট্রেনিং অন্তর্ভুক্ত নয়। বর্তমানে কর্মরত ১০ লক্ষ আইটি প্রফেশনালের সংখ্যা আগামী ২০২৫-এর মধ্যে ২০ লক্ষ করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের আইসিটি খাতে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর সফল ও দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য এটা একান্ত জরুরী। তাই আইসিটি ট্রেনিং-কে উৎসাহিত করতে এর উপরও ১০ বছরের কর অব্যাহতি রাখা প্রয়োজন।

নীতিনির্ধারকগণ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের প্রত্যাশিত উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং সত্যিকার অর্থে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়তে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো বাজেট অধিবেশনে আলোচনার মাধ্যমে বিবেচনা করবেন এবং অন্যান্য খাতের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্যও একটি ব্যবসা ও বিনিয়োগ বান্ধব বাজেট জাতিকে উপহার দেবে বলে প্রত্যাশা করছি।

লেখক: সৈয়দ আলমাস কবির। 

সভাপতি, বেসিস।

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন