নতুন রূপে সাইবার অপরাধ; কমেছে বুলিং; ঝুঁকিতে শিশুরা

টেকভিশন২৪ ডেস্ক: সাইবার স্পেসে ভুক্তভোগীদের দেওয়া মতামতের ভিত্তিতে শনিবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি মিলনায়তনে বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৩ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন এই খাতের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ)। 

সংগঠনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রতিবেদন পেশ করেন গবেষণা পর্ষদের সদস্য স্বর্ণা সাহা। সিসিএস কার্যনির্বাহী সদস্য খালেদা আক্তার লাবনীর সঞ্চালনায় প্রতিবেদনের ওপর আলোচনা করেন- ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন-আইএসপিএবি সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া, বিটিআরসি’র সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস মহাপরিচালক ব্রিগে.জে. মো. নাসিম পারভেজ,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাশেদা রওনক খান, সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা বিষয়ক জাতীয় কমিটি, বাংলাদেশের সদস্য প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমান এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) গবেষণা কর্মকর্তা নাহিয়ান রেজা সাবরিয়েত। আর ভিডিও বার্তায় দিয়ে আলোচনায় অংশ নেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের  বিজিডি ই গভ সার্ট প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম খান।

ধারাবাহিকভাবে পঞ্চম বারোর মতো প্রকাশিত এই  প্রতিবেদন বলছে, দেশে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন ধরনের অপরাধের মাত্রা বেড়েছে। প্রতিবেদনে ২০১৫-২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ের পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্র্যাফে। সেখানে ১১টি ট্যাবে করা তথ্য বিশ্লেষণে ‘অন্যান্য’ অপরাধের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে বলে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালের প্রতিবেদনে যেখানে অন্যান্য অপরাধ ছিল ১ দশমিক ৮১ শতাংশ।  ২০২৩ সালে প্রতিবেদনে এটি ৩৮১ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়ে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে নানা মাত্রিক প্রতারণা।  এই প্রতারণাগুলো হচ্ছে চাকরি দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস এবং অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে।   

তবে বরাবরের মতো অন্তর্জালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হলেও বিগত পাঁচ বছরে তুলনামূলকভাবে কমছে সাইবার বুলিং সংশ্লিষ্ট অপরাধের ঘটনা (অনলাইন ও ফোনে বার্তা পাঠানো, পর্নোগ্রাফি, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার ও ছবি বিকৃতি)। এ ধরনের অপরাধ ২০২২ সালে ৫২ দশমিক ২১ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছে,  যা ২০১৭ সালে ছিল ৫৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। 

সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য আইডি হ্যাকিংয়ের ঘটনাগুলোও ধারাবাহিকভাবে কমলেও আর্থিক সংশ্লিষ্ট প্রতারণা থেমে নেই। ২০২২ সালে ভুক্তভোগীদের ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশই অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। অপরদিকে ভুক্তভোগীদের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমের আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশই নারী। তারপরও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে অভিযোগের হার দিন দিন কমছে। ২০১৮ থেকে পাঁচটি জরিপে সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের মাঝে কতজন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছেন, তার ফলাফল উদ্বেগজনক। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ভুক্তভোগীদের মধ্যে অভিযোগকারীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। ২০১৮ সালের জরিপে যেখানে অভিযোগকারীর শতকরা হার ছিল ৬১ শতাংশ, ২০২৩ এ গিয়ে তা কমে ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশে নেমেছে।

এছাড়াও ২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে, যা ২০১৮ সালের জরিপের তুলনায় ১৪০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি (২ শতাংশের বেশি) অপপ্রচারের শিকার হয় শিশুরা। বয়সভিত্তিক অপরাধের ধরনে ভুক্তভোগীদের মধ্যে তরুণরা (১৮-৩০ বছর) সর্বোচ্চ (১২ শতাংশের বেশি) একই ধরনের অপরাধের শিকার।

সিক্যাফ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বশেষ জরিপে ভুক্তভোগীদের ৭৫ শতাংশের বয়সই ছিলো ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ২০১৮ সালের জরিপ থেকে এ পর্যন্ত একাধারে এই বয়সী ভুক্তভোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ এবং তাদের মধ্যে অধিকাংশই সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্টে অপপ্রচার ও আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার।     

আলোচনায় প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে অন্তর্জালে শিশু ভুক্তভোগীদের হার ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বক্তারা।  তাদের প্রত্যাশা, ক্রমবর্ধমান সাইবার অপরাধ পরিস্থিতির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে ডিজিটাল অবকাঠামো রক্ষা এবং নাগরিক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হবে। এজন্য সর্বাত্মক জনসচেতনতা গড়ে তুলে প্রযুক্তি ব্যবহারে নাগরিকের অভ্যাস ও আচরণগত উন্নয়নের মাধ্যমে সিক্যাফ জাতীয় নিরাপদ সাইবার সংস্কৃতি গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে সাধুবাদ জানিয়ে এই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন আলোচকেরা। সাইবার স্পেস এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে।

মাল্টিস্টেক কমিউনিটি অ্যাপ্রচে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে

বক্তব্যে নাহিয়ান রেজা সাবরিয়েত বলেন, গবেষণার মাধ্যমেই সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার হয়। সংখ্যা ভিত্তিক গবেষণা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাদৃত। জরিপে অংশগ্রহণকারীতের এলাকা, পেশা, অবস্থান ইত্যাদি বিষয় প্রকাশের পরামর্শ দেন তিনি। একইসঙ্গে তাদের স্টোরিগুলো তুলে আনার আহ্বান জানিয়ে ভুক্তভোগীদের মধ্যে শিশু ও তরুণদের হারটা মোটেই নেগলিজেবল নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেছেন, মাল্টিস্টেক কমিউনিটি অ্যাপ্রচে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, নিজেদের তৈরি নয় আমরা অজানা জায়গা থেকে আসা প্রযুক্তি ব্যবহার করি। তাছাড়া সাইবার দুনিটার পুরোটাই ধোঁয়াশায় পূর্ণ। এরই মধ্যে এসেছে চ্যাটজিপিটি যা কবি নজরুলেই কবিতা লিখে দিতে পারে। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের স্যলুশনগুলো নিজেদেরই তৈরি করতে হবে। এসময় ডিজিটাল ফরেনসিক তদন্তের জন্য সেগুলো নিরীক্ষা এবং ভুক্তভোগীদের চেয়ে অপরাধীদের বিষয়ে প্রচারণায় আলোকপাতের দাবি জানান তিনি।

ডিভাইসগুলো একদিকে যেমন বিনোদনের মাধ্যম; অন্যদিকে বিপদজনক

প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, ভুক্তভোগীদের মধ্যে পুলিশের সহায়তা না নেয়াটার হারটা বিপজ্জনক। এর পেছেনে ভুক্তভোগীদের প্রমাণ হাজিরের প্রক্রিয়াগত জটিলতাকে দূষেছেন তিনি। বলেছে, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে সাইবার জগতে যাপিত জীবনের বিষয়ে খোলামেলাভাবে আলোচনা করতে হবে। সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে শিশুদের ভুক্তভোগী হওয়ার সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। আমাদের বুঝতে হবে ডিভাইসগুলো একদিকে যেমন বিনোদনের মাধ্যম; অন্যদিকে বিপদজনক। কেননা এটা আমাদের বিচ্ছিন্ন করছে, যার প্রমাণ একই রাকে বুয়েট ও রুয়েটের শিক্ষার্থীর আত্মাহত্যা করার দুর্ঘটনা ঘটেছে গেলো বুধবার। তাই রাষ্ট্রকে আরো অগ্রণী ভূমিকা পালনের পাশাপাশি সামাজিক বন্ধনগুলো আরো দৃঢ় করতে হবে।

সাইবার সুরক্ষায় হটলাইন খুলছে বিটিআরসি

এই ধরণের প্রতিবেদন আমাদের দায়িত্ববোধ ও কাজের তাগিদ বাড়ে বলে অভিমত দেন বিটিআরসি’র সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস মহাপরিচালক ব্রিগে.জে. মো. নাসিম পারভেজ। তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যেই আইএসপি’দের প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবহার এবং মোবাইল অপারেটরদের সাইবার ডিভেন্স নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এখন আমরা শিগগিরই সাইবার সুরক্ষার জন্য একটি বিশেষায়িত কল সেন্টার স্থাপন করতে যাচ্ছি। তবে এরই মধ্যে কিশোরদের সাইবার সচেতনতায় ১৩২১৯ কলসেন্টার করা হয়েছে। এভাবেই মল্টিস্টেক হোল্ডার অ্যাপ্রোচে সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় কাজ করতে হবে। পাড়া মহল্লার ক্লাবগুলোকে এই সচেতনতায় অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। এখানে খুব পজেটিভ জার্নালিজম আমরা প্রত্যাশা করছি।

গুগল,ফেসবুক-কে বাংলাদেশে ডাটা সেন্টার স্থাপনে বাধ্যকরার দাবি

যে কন্টেন্ট আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না তা দেশে প্রবেশ করতে না দেয়ার বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে গুগল-ফেসবুক-কে বাংলাদেশে তাদের নিজস্ব ডাটা সেন্টার স্থাপনে বাধ্য করতে বিটিআরসি’র প্রতি অনুরোধ জানান ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন-আইএসপিএবি সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ২৭০০ আইএসপি-কে ডিডস আক্রমণ করা হচ্ছে। সাইবার থ্রেটটা আগামীর জন্য খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তিতে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। নীতিতেও আছে সীমাবদ্ধতা। এই সীমাদ্ধতা অতিক্রম করতেই আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। ব্যান্ডউইথ প্রবেশের সময়েই রাষ্ট্রের পক্ষেই এটি সুরক্ষিত কি না তা নিশ্চিত করা দরকার।

প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট www.ccabd.org  গবেষণাটির সম্পূর্ণ প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। 

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন