সরকারের ২০২৭ সালের মধ্যে ৭৫% ক্যাশলেস লেনদেনের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে ‘আমারপে’

টেকভিশন২৪.কম–এর নিয়মিত আয়োজন ‘টেক ইন্টারভিউ’। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসা, সফলতা-ব্যর্থতা এবং অনুপ্রেরণামূলক নানা বিষয় নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উদ্যোক্তার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় এ বিভাগে।

এবারের আয়োজনের অতিথি ‘আমারপে’র প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. এম. ইশতিয়াক সারওয়ার। আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক হালচাল এবং পেমেন্ট গেটওয়ে শিল্প নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন টেকভিশন২৪.কম নিউজ পোর্টালের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মো. গোলাম দাস্তগীর তৌহিদ।

অফিসের সহকর্মীদের সাথে এ. এম. ইশতিয়াক সারওয়ার।

টিভি২৪: আমরা জানি, ২০০৫ সাল থেকে আপনি তথ্যপ্রযুক্তি–ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কীভাবে এবং কী পরিমাণ পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিলেন?
ইশতিয়াক সারওয়ার: আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরুর পেছনে আমার বাবার অনুপ্রেরণা ব্যাপকভাবে ছিল। ২০০৫ সালে প্রায় শূন্য হাতে শুরু করা হয়, পরে বাবা বিভিন্ন সময়ে প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন। বাবার সেই বিনিয়োগগুলোর সঙ্গে আমার নিজের প্রচেষ্টা আর একাগ্রতায় খুব ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়েছি নিজের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানের অর্জিত আয় এবং মুনাফা দিয়েই ধীরে ধীরে সাফল্যের দেখা পেয়েছি।

টিভি২৪: সাধারণ পাঠকদের জন্য যদি বলতেন ‘পেমেন্ট গেটওয়ে’ জিনিসটা কী, কীভাবে কাজ করে এবং কাদের জন্য এটা প্রযোজ্য?
ইশতিয়াক সারওয়ার: পেমেন্ট গেটওয়ে হলো এক ধরনের ডিজিটাল প্রযুক্তি, যা অনলাইন ব্যবসাগুলোকে তাদের কাস্টমারের সঙ্গে নিরাপদ লেনদেনের প্রক্রিয়াকে সহজ করে। এটি কাস্টমার এবং মার্চেন্টের মধ্যে আর্থিক লেনদেনের যোগসূত্র বা ব্রিজ হিসেবে কাজ করে ৷ পেমেন্ট গেটওয়েগুলো সাধারণত ই-কমার্স ওয়েবসাইট, অনলাইন মার্কেটপ্লেস এবং ডিজিটাল প্লেসে কাজ করে এমন অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায় ব্যবহৃত হয়। পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবসা এবং গ্রাহক—উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ব্যবসার জন্য, একটি পেমেন্ট গেটওয়ে অনেকগুলো পেমেন্ট মেথড দেয়। তাই কাস্টমার বিভিন্ন মাধ্যমে খুব সহজে অর্থ প্রদানের পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে। সামগ্রিকভাবে, পেমেন্ট গেটওয়েগুললো নিরাপদে অনলাইন পেমেন্ট প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কাস্টমার উভয়ের জন্যই একটি নিরবচ্ছিন্ন পেমেন্ট গ্রহণের সেবা এবং সর্বজন স্বীকৃত।

টিভি২৪: ব্যবসায়িক অবস্থা বিবেচনায় বর্তমানে বাংলাদেশের অন্য পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর তুলনায় আপনার প্রতিষ্ঠান ‘সফট টেক ইনোভেশন লিমিটেড’ (আমারপে) কোন অবস্থানে রয়েছে?
ইশতিয়াক সারওয়ার: বর্তমানে আমরা দেশের প্রথম সারির দুটি পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত এবং সমাদৃত। দেশে এখন লাইসেন্সপ্রাপ্ত ৯টি পিএসও (পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর) আছে, তাদের মধ্যে আমরা একদম উপরের সারিতেই আছি।

টিভি২৪: বাংলাদেশে পেমেন্ট গেটওয়ের বর্তমান মার্কেট সাইজ কেমন? আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ইশতিয়াক সারওয়ার: আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে, আরো ইনোভেটিভ পেমেন্ট ফিচার চালু করা, যার মাধ্যমে সরকারের ২০২৭ সালের মধ্যে ৭৫% ক্যাশলেস লেনদেনের লক্ষ্য অর্জন করা। এর জন্য আমরা সুপার অ্যাপের দিকে নজর দিয়েছি এবং দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সুপার অ্যাপ হওয়ার প্রয়াস নিয়েছি, যা ইতোমধ্যে আন-অফিসিয়ালি চালু হয়ে গেছে।
আমাদের মার্কেট সাইজ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার মতো, যা প্রতি বছর বাড়ছে। ই–কমার্স ডিজাস্টারের জন্য কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও তা পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে এবং ২০২৪-২৫ নাগাদ স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। 

টিভি২৪: পেপাল, আম্যাজনপে, স্ক্রিল বা স্ট্রিপ–এর মতো আন্তর্জাতিক মানের পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানি হওয়ার বিষয়ে আপনাদের কি কোনো পরিকল্পনা আছে?
ইশতিয়াক সারওয়ার: আমরা সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে আমাদের প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছি। এই পদক্ষেপ নেয়াই হয়েছে গ্লোবাল এক্সপানশন এবং বিনিয়োগ গ্রহণের সহজ মাধ্যম প্রতিষ্ঠার জন্য। কারণ অনেক বিনিয়োগকারী সরাসরি বাংলাদেশে ফান্ড দিতে চায় না বিনিয়োগের টাকা ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ খুব সীমিত বিধায়।

টিভি২৪: এই ব্যবসায় আপনাদের কী কী চ্যালেঞ্জ বা রিস্ক নিয়ে কাজ করতে হয়? আর আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশি পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর সেবা ও নিরাপত্তার ধরনের মিল-অমিল কতটুকু?
ইশতিয়াক সারওয়ার: আমাদের ব্যবসায়িক ‌‌‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ অনেক বেশি থাকে, যার মধ্যে লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, আর্থিক ক্রাইম যাতে না হয় সেজন্য নিয়মিত মনিটরিং, মানি লন্ডারিং, টেররিস্ট ফাইনান্সিং, গ্যামব্লিং ইত্যাদির মতো বিভিন্ন কমপ্ল্যায়েন্স ইস্যু, রাষ্ট্রের আইন পরিপন্থী হয় এমন লেনদেনকে প্রিভেন্ট করার মতো দায়-দায়িত্ব আমাদের ওপর সবসময় অর্পিত থাকে। যা আমাদের টিম নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাচ্ছে দিনের পর দিন।

‘আমারপে’র বর্তমান সেবা এবং সিকিউরিটির মান সবক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সেবাগুলোর সমকক্ষ। আমারপে পিসিআই-ডিএসএস (PCI-DSS: Payment Card Industry-Data Security Standard) কমপ্ল্যায়েন্সপ্রাপ্ত, যা ভিসা এবং মাস্টারকার্ড কতৃক নির্ধারিত সিকিউরিটি মানদণ্ড। সেই সঙ্গে সম্প্রতি আইএসও সার্টিফিকেশন অর্জন করেছে ‘আমারপে’। যা সর্বাধিকভাবে (ISO 27001) ইনফরমেশন সিকিউরিটি কমপ্ল্যায়েন্স হিসেবে বহুল পরিচিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এসব কমপ্ল্যায়েন্স ‘আমারপে’ আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদানের সক্ষমতা অর্জন করতে সহায়তা প্রদান করেছে ব্যাপকভাবে।

উত্তরায় সুবিশাল অফিসে আমারপে’র কর্মকর্তাবৃন্দ।  

টিভি২৪: ‘আমারপে’র ইউনিক কিছু ফিচার সম্পর্কে জানতে চাই। আপনার প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি কী কী পুরস্কার ও সিকিউরিটি সার্টিফিকেট অর্জন করেছে?
ইশতিয়াক সারওয়ার: ‘আমারপে’ দেশের সবচেয়ে রিচ ফিচার এবং আধুনিক পেমেন্ট সেবা হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত এবং ব্যবহৃত। আমারপে একমাত্র পেমেন্ট গেটওয়ে, যার নিজস্ব সুপার অ্যাপ এবং মার্চেন্ট অ্যাপ আছে। সঙ্গে রয়েছে কাস্টম ইনভয়েস জেনারেট করার সুবিধা, যা দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেকোনো মাধ্যম দিয়ে পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে অনায়াসে। এছাড়া প্রতি লেনদেনে মেসেজ অ্যালার্ট, মেইল অ্যালার্ট, পেমেন্ট লিংক দিয়ে পেমেন্ট গ্রহণ, বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের সঙ্গে ইন্ট্রিগেশনের সর্বাধিক এপিআই (API) এবং প্লাগইন্স সুবিধা বিদ্যমান আমারপের সঙ্গে।
সম্প্রতি ‘ITEX 2023 মালয়েশিয়া’র মতো সন্মানজনক একটি প্রতিযোগিতায় ‘আমারপে’ অংশগ্রহণ করেছে এবং ‘ইনোভেশন ইন আইসিটি সেক্টর’–এ গোল্ড মেডেল অর্জন করেছে। যা দেশের হয়ে ফিনটেক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একমাত্র অর্জন। আমারপে পিসিআই-ডিএসএস এবং আইএসও সনদপ্রাপ্ত কমপ্ল্যায়েন্ট প্রতিষ্ঠান।

আমারপে লোগো।

টিভি২৪: আপনার ব্যক্তিগত জীবন এবং শখ বিষয়ে যদি জানাতেন।
ইশতিয়াক সারওয়ার: আমি দুই সন্তানের গর্বিত বাবা। এক ছেলে এবং এক মেয়ে। তাদের সঙ্গে সময় কাটানোটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দের। সঙ্গে গ্যাজেট, পারফিউম এবং ভ্রমণের শখ তো আছেই। পাশাপাশি বই পড়া, ইন্টারনেট সার্ফিং করে নতুন কিছু স্কিল অর্জন বা কর্মক্ষেত্রে প্রয়োাজন হয় এমন কিছু শেখা—এগুলো আমার নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মধ্যে পড়ে।

টিভি২৪: আপনার অন্যান্য ব্যবসায়িক উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাই। এছাড়া আপনার সেবাগ্রহীতা (ক্লায়েন্ট) এবং বাংলাদেশের পেমেন্ট গেটওয়ে ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যদি কিছু বলতেন।
ইশতিয়াক সারওয়ার: ২০০৫ সাল থেকে আমাদের এন্টারপ্রাইজ সলিউশন ব্যবসা আছে। যা মূলত দেশি-বিদেশি গ্রাহকদের চাহিদামতো ইআরপি, ওয়েবসাইট, ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং সলিউশন্স দিয়ে আসছে সুনামের সঙ্গে। ২০০৮ সালে আমাদের দ্বিতীয় ভেঞ্চার ‘মুঠোফান টেকনোলজিস লিমিটেড’ চালু হয়, যা এখনো সুনামের সঙ্গে মেসেজিং সার্ভিস বা A2P SMS সেবা দিয়ে যাচ্ছে, যা বিটিআরসি লাইসেন্সপ্রাপ্ত মেসেজিং এগ্রিগেটর। এছাড়া আমরা ডিজিটাল ল্যান্ডিং এবং ক্রেডিট স্কোরিংয়ের জন্য আলাদা একটি ফিনটেক প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছি, যা ‘রিনমিতি ফিন্টেক সলিউশন্স লিমিটেড’ নামে পরিচিত। আমাদের প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ভ্যালুয়েশন ১৮ মিলিয়ন ডলার। উত্তরায় সুবিশাল অফিসে ৭০ জনের মতো কর্মীবাহিনীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে।  
বর্তমান সরকার যেহেতু ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সেই প্রেক্ষাপটে আমরা ডিজিটাল ট্রানজেকশনের গ্রোথের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি এবং সেই প্রেক্ষাপটে নিরলসভাবে সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। সেই জায়গায় পেমেন্ট গেটওয়ে ইন্ডাস্ট্রি একটা মেজর রোল প্লে করছে এবং এর ফলে দেশের ডিজিটাল ইকোনমির ভিত্তি আরও সুদৃঢ় ও মজবুত হচ্ছে।

টিভি২৪: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
ইশতিয়াক সারওয়ার: আপনাকে এবং টেকভিশন২৪.কম–এর পাঠকদেরও ধন্যবাদ।

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন