আমিনুল বারী শুভ্র: ডেনমার্কের ডিজিটাল এজেন্সি সম্প্রতি মাইক্রোসফট-এর সঙ্গে কাজ স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে—এই ঘটনায় কেবল একটি ইউরোপীয় দেশের সিদ্ধান্তই নয়, বরং এটি এক গভীর বৈশ্বিক বার্তা বহন করে, ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব এখন আর বিকল্প নয়, এটি অপরিহার্য রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা।
ডেনমার্কের মতো একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশও আজ প্রযুক্তির সার্বভৌমতার জন্য সচেতন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। চীন বহু আগেই সেই পথে হাঁটছে। ডেনমার্কের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত একটি শক্তিশালী বার্তা দেয় যেখানে বিদেশি প্রযুক্তিনির্ভরতা শুধুই সেবা নেওয়ার বিষয় নয়—এটি একটি রাষ্ট্রের নীতিগত, নিরাপত্তাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কা তৈরি করে। বিশ্বের টেক জায়ান্টরা কখন, কীভাবে একটি দেশের ডেটা প্রক্রিয়াকরণ করবে—তার নিয়ন্ত্রণ সেই রাষ্ট্রের হাতে থাকে না।
ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো এখন “ডিজিটাল ইন্ডিপেনডেন্স” নিয়ে নতুন করে ভাবছে—যা একসময় কেবল রাজনৈতিক বক্তব্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ তা পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব মানে হলো—নাগরিক ও সরকারি তথ্য কোথায় সংরক্ষিত থাকবে, কে তার অ্যাক্সেস পাবে, কী প্রযুক্তিতে তা প্রক্রিয়াকরণ হবে—এসব বিষয়ের উপর রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। এ জন্য প্রয়োজন নিজস্ব ক্লাউড অবকাঠামো, নিরাপদ সফটওয়্যার, এআই ইঞ্জিন, এনক্রিপশন প্রযুক্তি ও কমিউনিকেশন মাধ্যম।
চীন বহু আগেই এই বাস্তবতা অনুধাবন করে কার্যকর কৌশল গ্রহণ করেছে। গ্রেট ফায়ারওয়ালের মাধ্যমে তথ্যপ্রবাহে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, নিজস্ব ক্লাউড (আলিবাবা, হুয়াওয়ে), অপারেটিং সিস্টেম (কাইলিন ওএস) এবং নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ ও সার্চ প্ল্যাটফর্ম (উইচ্যাট, বাইদু) তৈরি করে তারা বিদেশি প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা অনেকটাই কমিয়ে এনেছে।
ফলে চীন আজ একটি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তুলেছে, যেখানে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রয়েছে। ডেনমার্ক ও চীন—দুটি আলাদা পদ্ধতির প্রতীক হলেও, তারা একটিই মৌলিক প্রশ্ন সামনে এনেছে।
আপনার রাষ্ট্র কি নিজের প্রযুক্তির উপর দাঁড়িয়ে, নাকি বিদেশি প্রযুক্তির ভাড়া করা কাঠামোর উপর নির্ভরশীল? এই প্রশ্ন এখন আর শুধু তাত্ত্বিক নয়, বরং বাস্তব ও জরুরি:
• আপনার ডেটা কোন দেশের সার্ভারে সংরক্ষিত?
• যদি বিদেশি কোম্পানি হঠাৎ করে সেবা বন্ধ করে দেয়, আপনার বিকল্প কী?
• টার্মস অব সার্ভিস যদি হঠাৎ বদলে যায়, আপনি কতটা প্রস্তুত?
বাংলাদেশের জন্য করণীয়:
• ক্লাউড পলিসি ও জাতীয় ক্লাউড অবকাঠামো গড়ে তোলা
• নিজস্ব প্রযুক্তি (ইমেইল, চ্যাট, অপারেটিং সিস্টেম, সার্চ ইঞ্জিন) তৈরিতে বিনিয়োগ ও বেসরকারি খাত কে উৎসাহিত করা।
• এআই, বিগ ডেটা ও সাইবার সিকিউরিটি খাতে স্থানীয় দক্ষতা ও উদ্ভাবন বাড়ানো
• ডেটা লোকালাইজেশন আইন ও কনসেন্ট-ভিত্তিক তথ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা
• দেশীয় প্রযুক্তি কোম্পানির সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিদেশি চুক্তিতে সার্বভৌম শর্ত সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা
ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব এখন আর কেবল ভবিষ্যতের চিন্তা নয়—এটি আজকের বাস্তব চ্যালেঞ্জ এবং আগামী দিনের নিরাপত্তার পূর্বশর্ত।
আমিনুল বারী শুভ্র একজন সিনেসিস আইটির কর্মকর্তা এবং বর্তমানে তিনি “চিফ সল্যুউশন অফিসার” হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি ই-গভর্নেন্স এবং ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে কাজ করেন এবং সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।