শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫, ১:৪৩ অপরাহ্ণ
32.7 C
Dhaka

একটাই লক্ষ্য হতে হবে দক্ষ

মো: মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বর্তমান বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি আর সনদের ওপর নির্ভর করে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানো কঠিন। ‘একটাই লক্ষ্য হতে হবে দক্ষ’ – এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, যেখানে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের উপরও সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে। বিশেষত, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন অপরিহার্য। এই দক্ষতা কেবল ব্যক্তিগত জীবন বা কর্মজীবনের ক্ষেত্রেই নয়, একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বনাম দক্ষতা: একটি নতুন সমীকরণ

ঐতিহ্যগতভাবে, আমাদের সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই সফলতার একমাত্র চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হয়েছে। ভালো ফল, উচ্চশিক্ষা এবং একটি ভালো চাকরির লক্ষ্যেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক তাদের প্রচেষ্টা ব্যয় করেন। কিন্তু আধুনিক শ্রমবাজারের চাহিদা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগমন এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এখন কেবল মুখস্থ বিদ্যা বা তত্ত্বীয় জ্ঞান নয়, বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে সক্ষম ব্যবহারিক দক্ষতা এবং নতুন কিছু শেখার আগ্রহই কর্মজীবনে সফল হওয়ার পূর্বশর্ত।

আমরা দেখছি, উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের হার ক্রমবর্ধমান। এর একটি বড় কারণ হলো, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শিল্প ও ব্যবসার বাস্তব চাহিদার সমন্বয়হীনতা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর যে বিপুল সংখ্যক স্নাতক বের হচ্ছেন, তাদের অনেকেরই শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকে না। ফলে চাকরির বাজারে তাদের হিমশিম খেতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নকে আর ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে দেখা যাবে না, বরং এটি হয়ে উঠেছে অত্যাবশ্যকীয়।

দক্ষতা উন্নয়নের বিভিন্ন দিক ও এর অপরিহার্যতা

জীবনে লক্ষ্য অর্জন বা প্রতিষ্ঠিত হতে হলে যে সকল দক্ষতা অপরিহার্য, সেগুলোকে মোটা দাগে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:

১. সফট স্কিলস (Soft Skills): এগুলো হলো আন্তঃব্যক্তিক এবং ব্যক্তিগত গুণাবলী যা কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যেমন:

 * যোগাযোগ দক্ষতা: স্পষ্ট ও কার্যকর যোগাযোগ পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন এবং সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। উদ্যোক্তাদের জন্য গ্রাহক, বিনিয়োগকারী ও কর্মীদের সাথে কার্যকর যোগাযোগ ব্যবসার প্রসারের জন্য জরুরি।

 * সমস্যা সমাধান ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা: দ্রুত ও কার্যকরভাবে সমস্যা চিহ্নিত করা ও সমাধানের ক্ষমতা সফল ব্যক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

 * দলগত কাজ: একা কাজ করার সুযোগ সীমিত; একটি দলের অংশ হিসেবে কাজ করা এবং সম্মিলিত লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 * অভিযোজন ক্ষমতা: দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং নতুন জ্ঞান অর্জনে ইচ্ছুক থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

 * নেতৃত্বের গুণাবলী: অন্যদের অনুপ্রাণিত করা, নির্দেশনা দেওয়া এবং একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করার ক্ষমতা পেশাগত জীবনে এগিয়ে নিয়ে যায়।

 * সময় ব্যবস্থাপনা: সময়ের সঠিক ব্যবহার এবং কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষমতা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।

 * সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন: নতুন ধারণা তৈরি এবং প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

২. হার্ড স্কিলস (Hard Skills): এগুলো হলো নির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য এবং শেখার মতো দক্ষতা যা কোনো নির্দিষ্ট কাজ বা পেশার জন্য প্রয়োজনীয়। যেমন:

 * প্রযুক্তিগত দক্ষতা: ডিজিটাল যুগে কম্পিউটার লিটারেসি, মাইক্রোসফট অফিস, ডেটা অ্যানালাইসিস টুলস, কোডিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি দক্ষতা অপরিহার্য।

 * ডেটা বিশ্লেষণ: বিপুল পরিমাণ ডেটা থেকে অর্থপূর্ণ তথ্য বের করার ক্ষমতা আজকাল প্রায় সকল শিল্পের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।

 * আর্থিক ব্যবস্থাপনা: ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা, বাজেট তৈরি ও আর্থিক ঝুঁকি বোঝার ক্ষমতা সফলতার জন্য জরুরি।

 * ভাষা দক্ষতা: আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্যবসার প্রসারের জন্য একাধিক ভাষা জানা একটি মূল্যবান সম্পদ।

 * বিক্রয় ও বিপণন দক্ষতা: যেকোনো পণ্য বা সেবার সফলতার জন্য কার্যকর বিক্রয় ও বিপণন কৌশল জানা আবশ্যক।

উদ্যোক্তা জীবনে দক্ষতার ভূমিকা ও অপরিহার্যতা

একজন উদ্যোক্তা হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি ঝুঁকি নিয়ে নতুন কিছু তৈরি করেন, ব্যবসা শুরু করেন এবং পরিচালনা করেন। উদ্যোক্তা হওয়ার পথটি মসৃণ নয়; এখানে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তা থাকে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সফল হওয়ার জন্য উপরে উল্লিখিত দক্ষতাগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভালো আইডিয়া থাকলেই চলে না, সেই আইডিয়াকে বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য বহুমুখী দক্ষতার প্রয়োজন হয়। একজন উদ্যোক্তা একই সাথে বিপণনকারী, বিক্রেতা, হিসাবরক্ষক, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক এবং একজন দূরদর্শী নেতা। এসব ভূমিকা পালনে উল্লেখিত সফট ও হার্ড স্কিলসগুলো অপরিহার্য। পাশাপাশি, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নেটওয়ার্কিং, স্ব-প্রণোদনা ও শৃঙ্খলা এবং গ্রাহক সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা একজন সফল উদ্যোক্তার জন্য অত্যাবশ্যক।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের দক্ষতা অর্জনে অবদান

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপাপটে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (BTEB) দক্ষতা উন্নয়নে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের বিশাল কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরের ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অবদান অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান এবং উন্নয়নের জন্য গঠিত একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এর প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:

 * কারিকুলাম প্রণয়ন ও উন্নয়ন: BTEB শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন ও নিয়মিত আপডেট করে।

 * পরীক্ষা পরিচালনা ও সনদ প্রদান: পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও অন্যান্য ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফলের ভিত্তিতে ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট প্রদান করে BTEB।

 * প্রতিষ্ঠানের অধিভুক্তি ও মান নিয়ন্ত্রণ: কারিগরি শিক্ষা বোর্ড বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিভুক্তি প্রদান করে এবং তাদের শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করে।

 * শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ: BTEB শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করে।

 * শিল্পের সাথে সংযোগ স্থাপন: BTEB শিল্পের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কারিকুলাম ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতির উন্নতি সাধন করে।

 * নতুন কোর্স ও ট্রেড চালু: বাজারের পরিবর্তিত চাহিদা অনুযায়ী BTEB নতুন নতুন ট্রেড ও কোর্স চালু করে, যেমন তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি।

কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব ও অবদান:

কারিগরি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে তৈরি করে, যা তাদের দ্রুত কর্মসংস্থান পেতে সাহায্য করে। এটি দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব হ্রাসে ভূমিকা রাখছে। কারিগরি শিক্ষা শুধু চাকরির জন্যই নয়, স্ব-কর্মসংস্থান বা উদ্যোক্তা হওয়ার জন্যও দারুণ সুযোগ সৃষ্টি করে। এছাড়াও, দেশের অর্থনীতিতে দক্ষ জনবলের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে এটি জাতীয় উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

‘একটাই লক্ষ্য হতে হবে দক্ষ’ – এই মন্ত্রকে সামনে রেখে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের উপর জোর দিতে হবে, কারণ এটিই আজকের বিশ্বের চাহিদা। সফট স্কিলস এবং হার্ড স্কিলস উভয়ের উন্নয়নই ব্যক্তি জীবন ও কর্মজীবনে সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এই লক্ষ্য পূরণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তবে, এই ধারাকে আরও গতিশীল করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। দক্ষতা উন্নয়নকে জাতীয় অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং কারিগরি শিক্ষার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। যখন আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে দক্ষতাকেই মূল লক্ষ্য হিসেবে দেখা হবে, তখনই আমরা একটি সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হব।

এই সপ্তাহের জনপ্রিয়

ইন্টারঅ্যাক্টিভ ফ্ল্যাট প্যানেল মেলা; চলবে ১৯ তারিখ পর্যন্ত

টেকভিশন২৪ ডেস্ক: বিশেষায়িত আইটি পণ্যের প্রদর্শনী নিয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের...

আসল এবং নকল মোবাইল ফোন চেনার সহজ ৭ টি উপায়

টেকভিশন২৪ প্রতিবেদক: বর্তমানে মোবাইল ফোন বাজারে চলছে এক তুমুল...

আইটি প্রফেশনালস ক্লাব লিমিটেডের নতুন কমিটি গঠন

টেকভিশন২৪ ডেস্ক: প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত...

সর্বশেষ

স্টারলিংকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন, অফিসিয়াল রিসেলার বিএসসিএল

টেকভিশন২৪ প্রতিবেদক: শুক্রবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এক যৌথ...

স্টারলিংকের পরিবেশক হিসেবে গ্লোবাল ব্র্যান্ডের যাত্রা শুরু

টেকভিশন২৪ ডেস্ক: বাংলাদেশে স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক-এর সরকারিভাবে অনুমোদিত...

রিভো বাংলাদেশের ‘মুনসুন অফার’ ঘোষণা

টেকভিশন২৪ ডেস্ক: দেশজুড়ে নতুন এক ক্যাম্পেইন চালু করেছে দেশের...

গোপালগঞ্জে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ কিংবা বিঘ্নিত হয়নি:টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় 

গোপালগঞ্জে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ কিংবা বিঘ্নিত—কোনোটাই করা হয়নি বলে...

এ সম্পর্কিত

spot_img

জনপ্রিয় ক্যাটাগরি

spot_img